দেশটা কি আমরা আমজনতারা মাদক ব্যবসায়ীদের নিকট ইজারা দিয়ে দিয়েছি? তারা যা ইচ্ছা তাই করবে কিন্তু কীচ্ছুটি বলা যাবে না। টুশব্দটি করলে ধরে গর্দান নেবে। তারা হর্তাকর্তা হয়ে বসে আছে। দেখে শোনে তো অন্তত তাই মনে হচ্ছে। সংবাদে প্রকাশ, একজন কলেজছাত্র মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল। মাদকব্যবসায়ীরা ছাত্রটিকে পিটিয়ে একহাত দেখিয়ে দিয়েছে। এর মর্মার্থ কী হতে পারে?
মর্মার্থ আর যাই হোক, সেটা যে ভালো কীছু নয় সেটা বোধ করি কারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। ভালো কীছু নয় এর অর্থটা কেউ হয় তো ভাববেন, ‘একজন কলেজছাত্রকে পেটানো ভাল নয়’ পর্যন্ত। সে তো খারাপ কীছু করেনি। বরং খারাপ কীছুতে যুক্ত যারা তারই উল্টো তাকে ঠেঙিয়েছে। প্রথমেই এমন ভাবনা যে কেউ ভাবতেই পারেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ভাবনাটাকে একটু গভীরে নিয়ে যাওয়া উচিত, যে-কোনও সচেতন মানুষের ভাবা উচিত এমনটি হচ্ছে কেন? এমন অনৈতিক ও অন্যায় কাজ মাদক ব্যবসায়ীরা করছে কেন? এর থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে জাতিকে কী করতে হবে?
মাদকব্যবসা অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক একটি ব্যবসা। এই ব্যবসার সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বৃহৎ পুঁজি জড়িয়ে আছে। যে যাই বলুক, এই সত্যটি অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। বরং অস্বীকার করা হলে সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া হবে। প্রকৃতপ্রস্তাবে নিয়ন্ত্রক ক্ষমতার উচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সব স্থানে এই ব্যবসার প্রতিনিধি ও দালালরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। বাংলাদেশে পুঁজিবাদের সবচেয়ে খারাপ প্রবণতা মুক্তবাজার অর্থনীতি কার্যকর আছে। এই আর্থব্যবস্থায় মানুষের দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসহ মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা পর্যন্ত সব কীছু বিক্রি করে দেওয়ার মতো পণ্য পরিণত হয়। এই ব্যবস্থায় পুঁজি মানুষকে বস্তুর অধিক কীছু করে তোলে না। মানুষের স্বাধীনতার একটি বোধ থাকে, কিন্তু পণ্যের কোনও স্বাধীনতার বোধ থাকে না। পুঁজির দাসত্ব করার স্বাধীনতা ব্যতীত মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কারও কোনও স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয় না। কলেজ ছাত্রটি সেই স্বাধীনতার সীমা লঙ্ঘন করেছে এবং এই লঙ্ঘনের তাৎক্ষণিক ‘পুরস্কার’ পেয়েছে। তাতে অবাক হওয়ার কীছু নেই।
মুক্তবাজার অর্থনীতির পরিসরে মাদকব্যবসা এমন একটি আর্থনীতিক পদ্ধতি, যে-পদ্ধতির অধীনে পুঁজিবাদ সর্বোচ্চ মুনাফা লুণ্ঠন করতে পারে এবং সেই সঙ্গে মাদকের বাজার দেশটির যুবশক্তিকে মাদকাসক্তির কবলে ফেলে অনিবার্য মৃত্যুপথযাত্রী করে তোলে দেশটির উৎপাদন শক্তিকে বিনাশ করে, এবং এই দুর্বলতার সুযোগে দেশটিকে একটি আন্তর্জাতিক পুঁজির উপর নির্ভরশীল দেশে পরিণত করে আর্থনীতিক শাসন ও শোষণ চালিয়ে যায়, বলতে গেলে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাটিকেই দখল করে নেয়, দেশের কোনও স্বাধীনতা বলে কীছু থাকে না। এরকম দেশে মানুষ বেঁচে থাকে মাদক গ্রহণ করে অতিসত্বর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে যাপিতজীবনে কেবল মাদকগ্রহণের একটি জৈবিক যন্ত্র হিসেবে। যে-যন্ত্রের একটাই কাজ মাদকক্রয় করে পুঁজির সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করা। পরম পরিতাপের বিষয় এই যে, পুঁজি নিজের মুনাফা অর্জনের যন্ত্রটির ধ্বংস ছাড়া মুনাফা অর্জন করতে পারে না।
যে-মাদক ব্যবসায়ীরা প্রতিবাদী কলেজ ছাত্রটিকে বেধড়ক পিটিয়েছে, তারা আর কেউ নয়, তারা মাদকব্যবসার বিশ্বব্যাপী যে যন্ত্র তার কয়েকটি ‘নাটবল্টু’ মাত্র। মাদকব্যবসার যন্ত্রটির এইসব নাটবল্টুকে উৎখাৎ করা বর্তমান সময়ের একটি বড় জাতীয় কর্তব্য। বিশ্বব্যাপী এই জাতীয় কর্তব্যের আন্দোলন এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশও তার একটি শিরিক। দেশে মাদকবিরোধী অভিযানের সমালোচনা হচ্ছে। অভিযানের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ উঠছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার পক্ষালম্বন কোনও বিবেচনায়ই সমীচীন নয়। তারপরেও বর্তমান পরিস্থিতিতে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগটির বিরুদ্ধে যত জোর গলায় চেচানো হচ্ছে, তারচেয়ে লক্ষগুণ উদ্যম নিয়ে মাদকাসক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূল নিশ্চিত করার আন্দোলনে নামা এখন প্রতিটি দেশপ্রেমিক দলসংগঠনের কর্তব্য। বিচারবহির্ভূত হত্যা প্রতিরোধের আন্দোলনের আড়ালে মাদকবিস্তারের প্রবণতাটিকে আসকারা দেওয়ার অর্থ হলো অদূর ভবিষ্যতে ‘পুঁজির দাসত্ব করার স্বাধীনতা ব্যতীত মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কারও কোনও স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয় না’র জন্য অধীর অপেক্ষা করা এবং মাদকব্যবসায়ীদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তোলে দিয়ে ঘরে বসে মাদকগ্রহণ করে মৃত্যুর দিন গোনা।