পত্রিকায় (সুনামকণ্ঠ : ৫ এপ্রিল ২০২৪) শিরোনাম করা হয়েছে, “পাউবো’র উপ-সহকারী প্রকৌশলীর করা মামলায় জামিন পেলেন তিন কৃষক”। সংবাদবিবরণীতে লেখা হয়েছে, “কারাগার থেকে বেরিয়ে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সদস্য কৃষক আব্দুল হাই বলেন, দিরাইয়ের ভাটিধল গ্রামে পাউবো’র উপ-সহকারী প্রকৌশলী এটিএম মোনায়েম হোসেনকে মারধর ও সরকারি কাজে বাধা দেয়ার যে মিথ্যা মামলা করেছিলেন তা থেকে আজ আমরা জামিন পেলাম। ওইদিন এমন কিছুই হয়নি বরং ওই এসও আমাদের মারধর করে এবং হুমকিও দেয়। আমাদের মামলায় ফাঁসানোতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও সায় দেন। তার প্ররোচনায় এই মিথ্যা মামলাটি এসও মোনায়েম দায়ের করেন। মূলত বাঁধের কাজের অনিয়ম তুলে ধরে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন-প্রতিবাদ করার জন্যই আমাদের উপর চড়াও হন প্রশাসনের ওই কর্মকর্তা।”
কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা আর বিপরীতে কৃষকরা মামলা করছেন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। পত্রপত্রিকায় এমন পাল্টাপাল্টি মামলার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। আগে এমনটা ছিল না, একতরফাভাবে হাওররক্ষা বাঁধের বরাদ্দ লুটপাট চলতো সংশ্লিষ্টদের দ্বারা। ২০১৭ সালের শতভাগ হাওরডুবির ঘটনার পর থেকে হাওর বাঁচাও আন্দোলন কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং যথারীতি কৃষকরা সচেতন হয়ে উঠে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন। এখন হাওরাঞ্চলে কাঠামোগত সহিংসতা (হাওর রক্ষা বাঁধের সরকারি বরাদ্দ আত্মসাৎ করাও কাঠামোগত সহিংসতার সংজ্ঞানুসারে একটি সহিংসতা) প্রতিরোধের মুখে পড়েছে, তারই প্রতিক্রিয়া পাউবোর কর্মকর্তা কর্তৃক কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা। এই মামলা-পাল্টা মামলা দেশের ভেতরে বিদ্যমান কাঠামোগত সহিংসতাকে আরও প্রকটাকারে দৃশ্যমান করেছে।
কাঠামোগত সহিংসতা বর্তমান বিশে^ অবিচ্ছেদ্য একটি পুঁজিবাদী বাস্তবতা। প্রতিটি দেশের রাজনীতিক, আর্থনীতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে এটি প্রগাঢ়ভাবে বিস্তৃত, বহুরূপে তার প্রকাশ। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ কিংবা ফিলিস্তিনের গাজায় ইজরায়েলি আক্রমণ যেমন তার একটি উচ্চতর প্রকাশ তেমনি পাউবো প্রশাসনের সঙ্গে হাওরের কৃষকদের মামলাও তেমনি একটিÑ বলা যায়Ñ নি¤œতর প্রকাশ। অভিজ্ঞরা বলেন, এই কাঠামোগত সহিংসতার চর্চায় দেশের উপরমহল থেকে নিচের মহলের সর্ব শ্রেণিস্তরের মানুষেরাসহ রাজনীতিবিদ ও বিভিন্নস্তরের বুদ্ধিজীবীরা জড়িত থাকেন এবং এটি এমনভাবেই সমাজপরিসরে চর্চিত হয় যে, মনেই হয় না এটি একটি মানুষের বিরুদ্ধে করা মানুষের অপরাধ। এই জন্যে একজন সচিব অনায়াসেই বলতে পারেন, একটি অঞ্চলের অর্ধেক মানুষ কোনও দুর্যোগে মারা গেলেই তবে সে-উপদ্রুত অঞ্চলটি ‘দুর্গত’ বলে ঘোষণা করা যায়। ২০১৭ সালে শতভাগ ফসলডুবির পর সুনামগঞ্জকে দুর্গত ঘোষণার জনদাবি নাকচের পক্ষে এমনটিই ছিল সচিবের প্রতিযুক্তি।
আমরা মনে করি, সর্বাস্তৃত এই কাঠামোগত সহিংসতার অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনা নয় বরং সেটা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকেই বদলাতে হবে, অন্যথায় এই দুষ্টচক্রের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না, বরং পাউবো’র সঙ্গে কৃষকদের দ্বন্দ্ব আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হবে এবং কৃষক শোষিত হবে বেশি বেশি করে, পাউবো’র আত্মসাৎ চলতেই থাকেবে।