শামস শামীম ::
তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করছে সবাই। এই আগুনে গরমেও থেমে নেই হাওরের কৃষক। একমাত্র ফসল গোলায় তোলতে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাওরে অবস্থান করছেন কৃষক পরিবারের নারী ও শিশুরা। একমাত্র ফসলই হাওরের কৃষকদের একমাত্র ক্ষন্নিবৃত্তির অবলম্বন। শুধু কৃষক পরিবারই নয় মৌসুমী শ্রমিকরাও এখন হাওরে অবস্থান করছেন। তাদের সঙ্গে বউ ঝি ও সন্তান সন্তুতিরাও কাজ করছেন রোদে পুড়ে। ফসল তোলার সংগ্রামে এক হয়ে গেছেন হাওরের কৃষক শ্রমিক-সবাই। স্থানীয় কৃষকদের মতে ফসল তোলার এই সংগ্রামকেই হাওরাঞ্চলে ‘বৈশাখি’ বলে।
সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলার ছোট বড়ো ১৩৩টি হাওরে প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার কৃষক বোরো আবাদে জড়িত আছেন। এবার ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। প্রকৃতি অনুকূলে থাকায় দ্রুত ধান কাটা হচ্ছে সহজে। ধানকাটার সঙ্গে শুকানো, খড় সংগ্রহ ও গোলাজাতও করা যাচ্ছে প্রকৃতির দয়ায়। কৃষকদের মতে এবার বাম্পার বোরো ফলন হয়েছে হাওরে। কৃষি বিভাগের মতে এবার প্রায় চার হাজার ১১০ কোটি টাকার ধান উৎপাদিত হবে। যা গতবারের চেয়ে আরো ১১০ কোটি টাকা বেশি।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমির মধ্যে এ পর্যন্ত ১ লাখ ১৭ হাজার হেক্টর বা ৭১ ভাগ জমির বোরো ধান কাটা হয়ে গেছে। হাওর ও নন হাওর মিলিয়ে ৫৬ ভাগ ধান কাটা শেষ। ৮৫০টি হার্ভেস্টর ও ২০০টি রিপারের সঙ্গে ২ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিকও ধান কাটছেন। হার্ভেস্টরে একই সঙ্গে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাজাত করা যায় দ্রুত। একটি হার্ভেস্টরে দিনে ১০০ শ্রমিকের এবং একটি রিপার দিনে ২০ জন শ্রমিকের ধান কাটতে পারে। তবে কৃষকরা বলছেন হার্ভেস্টর বিতরণ নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে কৃষি বিভাগ। ৮৫০টি হার্ভেস্টর মাঠে আছে বলা হলেও বাস্তবে অর্ধেকও নেই। কৃষি বিভাগ, মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও সরবরাহকৃত কম্পানি সিন্ডিকেট করে যন্ত্রগুলো দেশের অন্যান্য স্থানে পাচার করে দিয়েছে। যে কারণে বিভিন্ন এলাকায় ধান কাটা বিলম্বিত হচ্ছে বলে কৃষকদের অভিযোগ। তবে যেসব এলাকায় হার্ভেস্টর সচল আছে সেসব এলাকায় ধান কাটা হচ্ছে দ্রুত।
২৫ এপ্রিল দেখার হাওরের পূর্ব নীলপুর সড়ক ধরে গ্রামের শেষ মাথায় এসে পতিত জমিতে পড়ে দেখা যায় দুই দিকেই হাওর। দেখার হাওরের এই অংশের নাম শাহপাথারিয়া। দৃষ্টিনন্দন গোচারণ ভূমি ধরে চলতে গিয়ে দেখা যায় দুই দিকের প্রায় ৭০ ভাগ ধান কাটা শেষ। এই ধান এখন শুকানো ও বস্তাজাত করছেন কৃষক কৃষাণীরা। ছলিমপুর গ্রামে এসে দেখা যায় গ্রামের পূর্বের দাইড়ের পাশে কান্দায় খলা তৈরি করে শতাধিক কৃষক কৃষাণী ধান শুকাচ্ছেন। অনেকে ধান কাটছেন ও মাড়াই দিচ্ছেন। গ্রামের নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর, কিশোরীসহ সব শ্রেণির মানুষকেই দেখা গেল মাঠে কাজ করতে।
এর আগে দেখা হয় ইসলামপুর গ্রামের কিষাণী খোদেজা বেগম (৭৫) এর সঙ্গে। তার শরীরের চামড়া কুচকে গেছে। বয়সের ভাঁজ লক্ষণীয় শিরা-উপশিরায়। তীব্র গরমের মধ্যেও এই বৃদ্ধা নাতি নাতনিদের নিয়ে ক্ষেতে এসেছেন। নাতিরা ধান কাটছে। তিনি কাঁচি দিয়ে খড় কেটে গোবাদিপশুর জন্য সংগ্রহ করছেন। খোদেজা বেগম বলেন, ‘কাম না করলে নাতি নাশা লইয়া খাইমু কি, চলমু কি কইরা। পেটের কাম বামনেও কইরা খায়। নিজের কাজে শরম করতে নাই।’ এই নারী জানালেন, তিনি বিয়ের আগেও বাবার বাড়িতে এভাবে মা-বাবার সঙ্গে কাজ করতেন। বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি এসেও একইভাবে কাজ করেন। তার মতো হাওরের গৃহস্থঘরের নারী, শিশু বৃদ্ধ সবাই এই সময়ে হাওরে কাজ না করে উপায় নাই বলে জানান তিনি।
তার অষ্টম শ্রেণি পড়–য়া নাতি শিব্বির আহমদ তখন তীব্র রোদ মাথায় হাওরে ধান কাটছিল। শিব্বির আহমদ বলেন, বইন্যা, পাত্তর আমরার শত্রু। দেখতে দেখতে ধান তলাইয়া লইয়া যায়। চাইয়া দেখা ছাড়া আর কিছু করার নাই। ইতার লাগি আমরা কামলার সঙ্গেও আউরো আইয়া ধান কাটি, শুকাই, বস্তাত ভরি। আমার অন্য বন্ধুরাও তারার মা বাবার সঙ্গে ই সময় আউরো কাজ করে।
পাশেই জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের শ্রমিক আলা উদ্দিন (৬৫)-কে দেখা গেল হাওরে ধান কাটতে। তিনি তার কিশোর ছেলে রমিজ মিয়াকে ধান কাটতে নিয়ে এসেছেন। সঙ্গে এসেছে এলাকার আরো ১৩জন শ্রমিক। তারা সাত হিস্যায় কৃষকের ধান কাটেন। সাত টুকরি ফেলে এক টুকরি ভাগে থাকে। ১৫-২০ দিন ধান কেটে তিনি ও তার ছেলে প্রায় ৩০-৩৫ মণ ধান সংগ্রহ করতে পারবেন বলে জানান। এতে তার সারা বছরের অন্নসংস্থানের সমস্যা হবেনা।
আলা উদ্দিন বলেন, ছোটবেলা থেকেই এই সময়ে আউরো ধান কাটতে আসি। এখন আমার ছেলে পুলেদের নিয়ে আসি। এই ধান কেটেই সারা বছরেই ভাত খাই। ধান কাটার আগে আউরো কৃষকের বাড়ি আই, কাটা শেষ কইরা যাই’। তবে এখন আর আগের মতো কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনি, ফরিদপুর, বরিশাল থেকে ‘বেপারি’ শ্রমিক আসেনা বলে জানান তিনি।
এভাবেই প্রতিটি হাওরে কৃষক ও শ্রমিক পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশুদের হাওরে ব্যস্ত দেখা গেছে। আরো ১০ দিন সময় পেলে হাওরের সব ফসল তারা গোলায় তুলতে পারবেন বলে জানিয়েছেন।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, হাওরের ৭১ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। হাওরের বাইরে যেসব উঁচু এলাকায় কৃষকরা আবাদ করেছেন তাও ৫০ ভাগ কাটা হয়ে গেছে। এবার হাওরে বাম্পার ফলন হবে। গতবারের চেয়ে আরো ১১০ কোটি টাকার বেশি ধান উৎপাদিত হবে। বন্যা, শিলা ও প্রাকৃতি ঝড়ে হাওরের ফসল আর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই বলে জানান তিনি। আগামী ৫ মে’র মধ্যে হাওরের শতভাগ ধান কাটা শেষ হবে। তবে নন হাওরের কিছু ধান মাঠে থাকবে।
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও সুনামগঞ্জ-৩ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য এমএ মান্নান বলেন, বৈশাখ হাওরের কৃষকের জন্য ফসল তোলার সংগ্রাম। সেই ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি নারী-পুরুষ সবাই ঘর ছেড়ে হাওরে চলে আসেন। শত শত বছর ধরে এই চিত্র দেখা যাচ্ছে। বাংলার এই কৃষকরাই কৃষি অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। যার নেপথ্যে নারীরাও অক্লান্ত কাজ করছেন। হাওরে এই সময়ে বাংলার অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখা নারীদের অক্লান্তভাবে কাজ করতে দেখা যায়। বাংলার নারী কিষাণীরা কতটা সংগ্রামী এই মওসুমে হাওর না দেখলে বোঝার উপায় নেই।