‘শিক্ষার্থীদের আলোকিত মানুষ হতে হবে।’ এবং বিধ বক্তব্যবাণী প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু সাধারণত ‘আলোকিত মানুষ’ বলতে কী বুঝায় তার বয়ানটা সেইসব বক্তব্যবাণীর ভেতরে তেমন প্রতিভাত হয় না। প্রতিভাত না হওয়ার একটি কারণ বোধ করি, বিদ্যমান আর্থসামাজিক কাঠমো সাপেক্ষে ব্যক্তিত্বের বিকাশ। আসলে ব্যক্তিত্ব তো সামাজিক সম্পর্ক ও সংস্কৃতি নিরপেক্ষ কোনও জৈবিক অস্তিত্বের বৈশিষ্ট্য নয়। সাধারণত ‘আলোকিত মানুষ’ বলতে যা বুঝায় বা বুঝানো হয়, আসলে সেটা আলোকিত মানুষের প্রকৃত রূপকল্প নয়। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়েয াওয়ার পর এখনও, ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি, আইন ব্যবস্থা ও প্রশাসন বলতে গেলে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত আছে সেখানে প্রকৃতপ্রস্তাবে, দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে, কোনও ‘আলোকিত মানুষ’ আবির্ভাবের কোনও সামাজিক-রাজনীতিক পরিসর প্রেক্ষিত নেই। এই তো ক’বছর আগে কীছুটা প্রগতিশীল শিক্ষানীতি প্রণয়নের প্রচেষ্টা হেফাজতি চাপের মুখে বাতিল করে দিতে হয়েছে। অথবা সুনামগঞ্জে সিভিল সার্জনের দুর্নীতির প্রতিবাদে মানববন্ধন ক্ষমতাধর দলের জনৈক ছাত্রনেতার আক্রমণের দাপটে প- হয়ে গেছে এবং সেটা দিন-দুপুরে প্রত্যক্ষ করা গেছে। একজন বিরোধী দলের নেতা, বর্তমানের শাসন-প্রশাসনের তুলনা টানতে গিয়ে বলেছেন, ‘পাকিস্তান আমলই ভালোছিল।’ এই যদি হয় লাউড়ে-গৌড়ে বিস্তৃত সমাজকাঠামোর সাংস্কৃতিক পরিসরে বিভিন্ন বিষয় প্রপঞ্চের প্রতিফলন, তাহলে বলাই যায় যে, এমন সমাজ পরিসরে প্রকৃত ‘আলোকিত মানুষ’-এর আবির্ভাব এখানে আসলেই অকল্পনীয় এবং অসম্ভব। কেউ বলতেই পারেন, যেমন বলেন ‘নতুন দিগন্ত’-এর সম্পাদক, সম্প্রতি তিনি বলেছেন, ‘সংগ্রাম করে আমরা জয়ী হয়েছি। কিন্তু সর্বত্রই তো দেখতে পাই পরাজয়ের চিহ্ন। মনে হয় আমরা পরাজিত হয়ে গেছি। সেটা এই বিশেষ অর্থে যে উন্নতি আমাদের মুক্তি দেয় নি। উন্নতিটা মানবিক হয়নি, হয়েছে শত্রুভাবাপন্ন। এক কথায় পুঁজিবাদী।’ পরাজিত ও অধীন মানুষ, সাধারণত দাসত্বের শিকলে আবদ্ধ মানুষ, তার যাপিত জীবনের পরিসরে থেকে কখনও ‘আলোকিত মানুষ’ হতে পারে না। আলোকিত মানুষ হতে গেলে তার সব কীছু সুন্দর হওয়া চাই।
এই সুন্দর হওয়াটা কী? সে-টা হলো, মানুষের সর্বাঙ্গীন ও সুষম বিকাশের জন্য চিৎপ্রকর্ষ (চিন্তার উন্নতি), নৈতিক শুদ্ধতা ও শারীরিক উৎকর্ষের (নীরোগ দেহে শরীরের উচ্চতর জৈবিক বিকাশ) সংযোগ সাধনÑমানুষের মধ্যে এই তিনটির সমাহার। মানুষের এমন সুন্দর হওয়ার গুরুতর শত্রু হলো বিদ্যমান পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদের উৎখাত সম্ভব না হলে মানুষ কখনওই ‘আলোকিত মানুষ’ হতে পারবে না। এইটুকু বক্তব্য পরিবেশনের পর, ‘আলোকিত মানুষ’ তৈরির জন্য কর্তব্য কী সেটা বলে না দিলেও চলে বা বলার প্রয়োজন বোধ করছি না।