গণমাধ্যমে শিরোনাম করা হয়েছে ‘বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ : হাওরাঞ্চলে বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধান দাবি’। বলা হয়েছে, ‘হাওরাঞ্চলে বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে সুনামগঞ্জে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির জেলা সাব কমিটি ‘হাওরাঞ্চলের বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধান আন্দোলন পরিচালনা কমিটি’ এই কর্মসূচির আয়োজন করে।’
একটি রাজনীতিক সংগঠন এই দাবিটি তুলে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, দাবিটি সুনামগঞ্জের বিশেষ করে হাওরাঞ্চল বা বাংলাদেশের সমগ্র ভাটি এলাকার সাধারণ মানুষের দাবি। এই দাবিটিকে উপেক্ষা করার কোনও রাজনীতিক-আর্থনীতিক যৌক্তিকতা নেই। দলমত নির্বিশেষে যে-কোনও রাষ্ট্র-পরিচালনা ব্যবস্থার পক্ষেই এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করে হাওরাঞ্চলের প্রাণপ্রকৃতিকে সংরক্ষণ তথা প্রকৃতিকে মানববান্ধব করে রাখার কাজে নিয়োজিত হওয়া একটি সাধারণ প্রাথমিক কাজ বলেই স্বীকৃত হওয়া উচিত, যে-প্রাথমিক কাজকে উপেক্ষা করে কোনও রাষ্ট্র-পরিচালনা ব্যবস্থার পক্ষে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নীতি অনুসারে নৈতিকতা বিবর্জিত আচরণ। রাষ্ট্র-পরিচালনা ব্যবস্থা যদি রাষ্ট্রপরিধির ভেতরের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা করতে না পারে তবে সামগ্রিক অর্থে রাষ্ট্র-পরিচালনা ব্যবস্থাটি নিজেকে প্রকৃতপ্রস্তাবে ব্যর্থ প্রমাণিত করে। কারণ কোনও স্থানের প্রাণ-প্রকৃতি বিনষ্ট হলে বা তার ভারসাম্য বিনষ্ট হলে রাষ্ট্রের মূল উপাদান জনগণের অস্তিত্ব বিঘিœত হয়ে রাষ্ট্রের শাসনবিস্তারের একেবারে বিলুপ্তি না ঘটালেও ব্যবস্থাটির মুখে একধরণের ব্যর্থতার কালিমা লেপন করে। এমন হলে রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতরে প্রচলিত প্রশাসনিক কর্মকা-ের থাকা না থাকার কোনও সার্থকতা প্রতিষ্ঠিত হয় না এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নীতিকে একটি অনৈতিক প্রাপঞ্চিকতায় (ফেনোমেনায়) পর্যবসিত করে।
সুনামগঞ্জ বিশেষ করে বাংলাদেশের বিশাল ভাটি অঞ্চলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতাসঞ্জাত কারণে হাওরের জৈবপ্রজাতির বিলুপ্তি ও বিশেষ করে জলাবদ্ধ বন্যার প্রাদুর্ভাব এখানকার প্রাণপ্রকৃতির উপর ভয়াবহ অভিঘাত হানছে এবং এখানকার প্রাণপ্রকৃতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ভাটি অঞ্চলের এবংবিধ প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্টের ঘটনা এখন এতোটাই প্রকট হয়ে উঠেছে যে, কারও পক্ষে কোনও ভাবেই এই ভয়ঙ্কর বিনষ্টিকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। সম্প্রতি কেউ কেউ তো ভাটি বাংলার সমুদ্রসদৃশ জলের বিশাল বিস্তৃতিকে জলের মরুভূমি বলে অভিহিত করতে কসুর করছেন না। কারণ সেখানে জলাধার থেকে পাওয়া যায় বা পাওয়া যেতো এমন প্রাকৃতিক সম্পদ (বিশেষ করে মাছ) আর বলতে গেলে পাওয়াই যাচ্ছে না।
এটা একটি ব্যাপকাকারের প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার বাস্তব উদাহরণ। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘিœত হওয়ার কারণে প্রকৃতপ্রস্তাবে ভাটিবাংলা আর ভাটি বাংলা থাকছে না, ভাটি বাংলার চিরন্তন বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হওয়ার হুমকির মুখে পড়েছে। এই হুমকিটি হাওরের প্রতিবেশে মানুষের বেঁচে থাকার প্রতিও হুমকি বটে। হাওরের মানুষ হাওরকে নিয়েই বাঁচতে চায়। এই উপলব্ধিকে ধারণ করে একটি রাজনীতিক সংগঠন বিক্ষোভ মিছিল করেছে। এই বিক্ষেভ মিছিল প্রকৃতপ্রস্তাবে ভাটি বাংলার সর্বস্তরের মানুষের দাবির প্রতিনিধিত্ব করেছে। এই দাবিটি রাজনীতিক-আর্র্থনীতিক যুক্তির প্রেক্ষিতে স্বীকার করে নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে অচিরেই সমাধানের লক্ষ্যে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে কার্যকর করতে অগ্রসর হওয়া উচিত।
দাবিটি এমনি এমনি আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়েনি। এর একটা ইতিহাস আছে। একদা ব্রিটিশরা এখানে নদীখাল খননের কাজ তাদের বাণিজ্যের প্রয়োজানুসারে যতোটুকু না করলেই নয় ততোটুকু করতো। তৎপরবর্তী সময় থেকে ভরাট হওয়ার প্রক্রিয়ায় পতিত হওয়া নদী-খাল খননের কাজের প্রতি একবারেই পুরোপুরি উপেক্ষা করতে করতে ও হাওরের ভেতরে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের বদৌলতে সাম্প্রতিক সময়ে এসে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, জল সমুদ্রে সঞ্চালিত হওয়ার প্রবহমানতা বিঘিœত হয়ে এখন জলাবদ্ধ বন্যার আবির্ভাবকে অনিবার্য করে তোলেছে এবং এই জলাবদ্ধ বন্যার তা-বে জনজীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। এর একটি বিজ্ঞানসম্মত কার্যকর নিরসন চাই। রাষ্ট্রপরিচালন ব্যবস্থার পক্ষ থেকে করিবকর্মাধর্মী আমলাতান্ত্রিক উপেক্ষা চাই না।