বিশেষ প্রতিনিধি ::
ইতালি নেয়ার কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে সুনামগঞ্জের আক্তার হোসেন (২৮) নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেছে দালাল চক্র। এখন সেখানকার হাসপাতালে বেওয়ারিশ হিসেবে পড়ে আছে তার মৃতদেহ। হাসপাতালে মৃত যুবকের যুবকের কাছ থেকে পাসপোর্টের ফটোকপি পেয়ে বাড়িতে যোগাযোগ করে পরিবারকে মৃত্যুও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সেখানে বসবাসরত আরেক বাংলাদেশি শ্রমিক। তিনি পরিবারের কাছে হাসপাতালে থাকা ওই যুবকের নিথর ছবি ও ভিডিও পাঠিয়েছেন। এ ঘটনায় পরিবারে মাতম চলছে। স্থানীয় দালাল ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন নিহত যুবকের স্বজনরা। লিবিয়ায় নিহত আক্তার হোসেন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের মুড়ারবন্দ গ্রামের সিরাজুল হকের ছেলে।
পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ বছর মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই-এ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন আক্তার হোসেন। গত বৈশাখে তিনি দেশে আসেন। জ্যৈষ্ঠ মাসে আবারও দুবাই যান। দেশে আসার পর বিশ্বম্ভরপুরের হরিপুর গ্রামের হুমায়ুন মিয়া ও সদর উপজেলার শাফেলা গ্রামের আক্তার মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ হয় ওই যুবক ও তার পরিবারের। তারা তাকে জানায় ১১ লাখ টাকা দিলেই ইতালি সহজে যাওয়া যাবে। হুমায়ুন দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়ায় থাকেন এবং অবৈধভাবে মানবপাচারকারী চক্রের হয়ে প্রলোভনে ফেলে যুবকদের দেশ থেকে নিয়ে যান বলে জানান আক্তার হোসেনের পরিবারের লোকজন।
স্বপ্নের দেশ ইতালির স্বপ্নে বিভোর আক্তার হোসেন ও তার পরিবার ছেলেকে ইতালি পাঠানোর জন্য হুমায়ুন ও আক্তার মিয়ার দেওয়া শেরপুর, নবাবগঞ্জ, চাপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার দালালদের আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাংক একাউন্টে বিভিন্ন সময়ে ১০ লাখ টাকা পাঠান। পরে আখতার হোসেনকে দুবাই থেকে লিবিয়া নেওয়া হয়। কথা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে গেইমে না তুলে আরো টাকার জন্য নানা ছুতোয় হুমকি-ধমকি দেন হুমায়ুন ও আখতার মিয়া। আক্তার হোসেন পরিবারের কাছে এসব কথা জানালে আবারও হুমায়ুনের ভাই আফজল, আখতারের স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে ১ মাস আগে আরো নগদ ৩ লাখ টাকা দেন সুদে এনে। লিবিয়ায় আক্তারকে জিম্মি করে ও মারধর করে আরো টাকা দাবি করেন হুমায়ুন। পরে আবারও আরো ৩ লাখ টাকা জমি বিক্রি করে দেন আক্তারের পরিবার। কিন্তু বারবার টাকা নিয়েও তাকে ইতালি না পাঠানোয় প্রতিবাদ করেন আক্তার। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে হুমায়ুন ও অন্যান্য মানবপাচারকারীরা আখতারকে মাথায়, কপালে, বুকে, কানে আঘাত করে। তার মাথা থেতলে দেয়। তারা তাকে মেরে একটি সড়কের পাশে ফেলে রেখে যায়। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় সেখানকার পুলিশ আক্তারকে হাসপাতালে নিয়ে এসে পোস্টমর্টেম করে মর্গে রেখেছে।
আখতারের স্বজনরা জানান, ৩-৪ দিন আগে আক্তার ভয়েস ম্যাসেজ পাঠালেও নেটওয়ার্ক না থাকায় সেটা শোনা হয়নি। ভয়েস ম্যাসেজে হুমায়ুন তাকে হুমকি-ধমকি দেয় বলে জানান পরিবারের কাছে। তবে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় সেটা তাৎক্ষণিক শুনতে পারেননি পরিবারের লোকজন। উল্লেখ্য সম্প্রতি হুমায়ুনের ভাই আফজল মানবপাচারের মামলায় জেল খেটে এসেছেন। এই আফজালও আখতার হোসেনের পরিবারের কাছ থেকে নগদ টাকা নিয়েছেন বলে জানান নিহতের স্বজনরা।
আখতারের ভাই জাকির হোসেন মাসুম বলেন, হুমায়ুন ও আখতার দালালের মাধ্যমে আমরা তাদের দেওয়া বিভিন্নজনের ব্যাংকে ১০ লাখ টাকা পাঠাই। পরে আমার ভাইকে জিম্মি করে তার স্ত্রী, ভাই, শ্বশুর ও শাশুড়িকে দিয়ে দুই দফা আরো ৬ লাখ টাকা নেওয়ায়। এরপর গেইমে না তুলে আমার ভাইকে পিটিয়ে খুন করে রাস্তায় ফেলে যায়। সেখান থেকে তাহিরপুরের গুটিলা গ্রামের সুরতজামান আমার ভাইয়ের পকেটে পাওয়া পাসপোর্টের কপি থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে আমাদেরকে ভাই হত্যার ছবি, ভিডিও পাঠান। হুমায়ুন দালাল আমার ভাইকে বুকে, মাথায় ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে। আমরা ভাইকে ইতালি পাঠাবার স্বপ্নে জমিজমা বিক্রি করে, সুদে টাকা এনে দালালকে দিয়েছিলাম। দালাল আমার ভাইটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। আমরা শেষবারের মতো ভাইয়ের মরা মুখটি দেখতে চাই। মাসুম বলেন, আমরা শিঘ্রই দালাল হুমায়ুন ও আখতার দালালসহ তাদের আত্মীয়দের মধ্যে যারা টাকা নিয়েছে তাদের নামে মামলা করবো।
মুড়ারবন্দ গ্রামের সোহেল আহমদ বলেন, একটি পরিবার ছেলেকে স্বপ্নের দেশ ইউরোপে পাঠাতে নিঃস্ব হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত দালাল চক্র ছেলেটিকেও মেরে ফেলেছে। এখন লিবিয়ায় হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে তার মরদেহ। এখন পরিবারের লোকজন লিবিয়া থেকে তার লাশ ফেরত আনতে চান। মা শেষ বারের মতো ছেলের মরা মুখ দেখতে চান। তিনি স্থানীয় যে দুই দালাল দফায় দফায় তাকে জিম্মি করে টাকা নিয়েছে তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। তিনি বলেন, হুমায়ুন দালালের ভাই কিছুদিন আগে মানবপাচার মামলায় জেল খেটেও এসেছে।
বৃহস্পতিবার রাতে লিবিয়ায় অবস্থানরত তাহিরপুরের গুটিলা গ্রামের সুরত জামানের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমি হাসপাতালে ওষুধ নিতে এসে বাংলাদেশি একজন মরে পড়ে আছে জানতে পেরে এগিয়ে আসি। তখন তার পকেটে পাসপোর্টের ফটোকপি পেয়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মৃত্যুর খবর দেই এবং ছবি ও ভিডিও পাঠাই। পোস্টমর্টেম শেষে ওই যুবকের মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে পুলিশ দাফন করবে বলেও জানান তিনি।
হুমায়ুনের বাবা ময়না মিয়া বলেন, আফজাল কিছুদিন আগে জেল থেকে বেরিয়েছে। তার ছেলে হুমায়ুন আখতার হোসেনকে ইতালি নেওয়ার জন্য টাকা নিয়েছে কি না তার জানা নেই। তার মোবাইল ফোন বন্ধ বলেও জানান তিনি। আফজল তার ভাই হুমায়ুনের হয়ে টাকা নিয়েছে কি না তাও জানেন না বলে জানান তিনি।
সুনামগঞ্জ সদর থানার ওসি খালেদ চৌধুরী বলেন, বিষয়টি আমাদের জানা নেই। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হলে আমরা পরিবারটির সঙ্গে যারা প্রতারণা করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেব।