গত শনিবারে (১১ জুন ২০২২ খ্রি.) দৈনিক প্রথম আলোর একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘জ্বলন্ত ট্যাংকার ২ কিলোমিটার চালিয়ে নিয়ে গেলেন ফায়সাল’। সংবাদে বলা হয়েছে, “পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটায় সড়কের পাশে পেট্রলপাম্পে রাখা তেলের ট্যাংকারে … হঠাৎ আগুন ধরে যায়। বিস্ফোরণে বিপুল প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কায় নিজের জীবন বাজি রেখে জ্বলন্ত ট্যাংকারটি প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে নিয়ে যান চালক। … এটা যে ভয়ঙ্কর একটি মুহূর্ত ছিল স্বীকার করেন ফায়সাল। সাহসী এই চালক বলেন, ‘ধরেই নিয়েছি আমি মারা যাব, কিন্তু লোকজনকে (বাঁচানো) নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম।’ ট্যাংকারচালক আরও বলেন, প্রতিবার যখনই তিনি ট্যাংকার থামাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন, তখন কাছাকাছি কিছু লোক দেখতে পান। এতে তিনি ট্যাংকার চালিয়ে নিতে বাধ্য হন।”
অন্য মানুষের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে একজন সাধারণ মানুষ যখন নিজের প্রাণকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত তখন ইউক্রেনে হাজার হাজার লোককে বিশ্বের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদরা প্রকারান্তরে হত্যা করে চলেছেন, চূড়ান্ত বিবেচনায় মুনাফা বাগিয়ে নেওয়ার অভিপ্রায়ে, কেবল আর্থনীতিক লাভ নিশ্চিত করার জন্যে। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মনোবৃত্তিতেও তার ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় না। এখানেও বছর কয়েক আগে কোনও এক প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ বলে বসেছিলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকেটি ছাত্রের লাশ যদি পড়েই তাতে না কি, তাঁর লাভ ছাড়া কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। এবং এই দেশে অদূর অতীতের একদা হরতালের সময় যাত্রীভরা বাসে পেট্রলবোমা ছোঁড়া হয়েছিল কোনও একটি বিশেষ রাজনীতিক দল ও জোটের পক্ষ থেকে। এবং তাছাড়া রাজনীতিক প্রতিপক্ষ পারস্পরিক দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়ে হরহামেশা খুন-জখম তো করেই চলেছেন সেই একাত্তরের পরবর্তী সময় থেকেই। এবং এমনকি এ দেশে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদের উত্থান পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করা গেছে। অর্থাৎ দেশে বিদেশে কমবেশি মাত্রায় আসলে একই অবস্থা বিরাজ করছে এবং বিবেচনা করা যেতেই পারে যে, পুরো পৃথিবীটা একটি মূর্তিমান বধ্যভূমিতে পরিণত হয়ে পড়েছে এবং সেটা করা হচ্ছে অস্ত্র দিয়ে কিংবা মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ-দুর্যোগ লাগিয়ে, যেখানে লেশ মাত্র মানবতার উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। বিশ্বজুড়ে রাজনীতির খুনি চরিত্র এখন সবচেয়ে হিংস্র রূপ ধারণ করেছে। এক বিবেচনায় ১৯৪৫ সালে অ্যাটমবোমা ফাটিয়ে হিরোসিমা ও নাগাসাকি ধ্বংস করে দেওয়ার চেয়েও ভয়ঙ্কর সে-হিংস্রতা। কারণ এই হিংস্রতা এখন বিশ্বব্যাপী কাঠামোগত সহিংসতার রূপ ধারণ করেছে। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, পৃথিবীতে যুদ্ধ কেন হবে কিংবা একজন বিল গেটস কেন তৈরি হবেন? অর্থনীতিটা এমন নির্মম ও অমানবিক হবে কেন? একজন সাধারণ মানুষ যতোটা সহজে নিজের প্রাণ বিসর্জনের সংকল্প নিয়ে হলেও অন্যের প্রাণ রক্ষার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারেন, বিপরীতে রাজনীতিবিদরা তার উল্টোটা করে তৃপ্ত হন, তাঁরা ফায়সাল হতে পারেন না। বরং তাঁরা পুঁজির প্রভুত্বকে কায়েম রাখতে গিয়ে, নিজেদের বাজার সম্প্রসারণ করতে গিয়ে পুরো পৃথিবীটাকেই বধ্যভূমি বানিয়ে দিয়েছেন, এবং সেটা করেছেন অনেক কাল আগেই। তাঁরা আর বদলাতে চান না নিজেদের এই খুনি রূপ, এই রূপেই বিশ্বমুণ্ড চিবিয়ে খেতে তাঁরা বড়বেশি পছন্দ করেন।
এ বিষয়ে আর কীছু বলার নেই আপাতত। অনেকেই অনেক কীছু বলেছেন এবং বলতেই আছেন। কিন্তু ঘটনা দাঁড়াচ্ছে, “যত বলা হোক, কে শোনে কার কথা”। কেবল বলি, এই নির্মম খুনি রাজনীতি নিপাত যাক এবং রাজনীতিবিদরা ট্যাংকারচালক ফায়সালের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করুন। এ ছাড়া তো পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তৃত চলমান হত্যাযজ্ঞ রোধের কোনও বিকল্প দেখছি না।