বিশেষ প্রতিনিধি ::
নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও সুনামগঞ্জের হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ এখনো শেষ হয়নি। মাটি কাজের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে বাঁশ, বস্তা, জিওটেক্স, কমপেকশন বাকি রয়ে গেছে। কাজ আদৌ সম্পন্ন করা হবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান স্থানীয়রা। জামালগঞ্জের পাগনা, হালি, মহালিয়া হাওরসহ একাধিক হাওর ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। একই চিত্র শাল্লা, দিরাই, ধর্মপাশা, শান্তিগঞ্জ, জগন্নাথপুর, বিশ্বম্ভরপুরসহ সবগুলো হাওরেই। যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় কৃষকরা। ২০১৭ সন থেকে কাবিটা প্রকল্পে হাওরের কৃষকদের মাধ্যমে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠন করে হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধের কাজ হচ্ছে। তবে নীতিমালা অনুযায়ী কাজে অকৃষক ও মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা কাজ বাগিয়ে নেন এমন অভিযোগ আছে। জেলা কাবিটা মনিটরিং কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সদস্য সচিব হিসেবে নির্দিষ্ট কমিটির মাধ্যমে প্রকল্প গঠন ও অনুমোদন দেন।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর পওর বিভাগ-১ এর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মওসুমে জেলার ৩৭টি ছোট বড়ো হাওরের ৫৯১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সংস্কার ও ও রক্ষণাবেক্ষণে ৭৩৩ পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠন করা হয়। ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২৩ সনের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সনের ২৮ ফেব্রুয়ারি কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু গত ১ মার্চ পর্যন্ত ৯০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে দাবি করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু সরেজমিন ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে কাজ এখনো ৪০ ভাগের মতো কাজ বাকি আছে। তবে কাজ শেষ হয়েনি স্বীকার করে নিয়ে এক সপ্তাহ সময় বাড়ানোর আবেদন করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, জামালগঞ্জ ও তাহিরপুর উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত হালির হাওরের ৪০ নং প্রকল্পের ৪০ ভাগ কাজ এখনো বাকি রয়ে গেছে। ১১ নম্বর থেকে ২০ নম্বর পর্যন্ত বাঁধগুলোর কাজেরও একই অবস্থা। এর মধ্যে ১৬ ও ১৭ নম্বর প্রকল্পে অর্ধেকের কাজ বাকি আছে। ২০ ও ২১ নম্বর প্রকল্পে নামকাওয়াস্তে মাটি ফেললেও কমপেকশন ও দুর্বাঘাস লাগানো হয়নি। ২৪ নং প্রকল্পে কেবল ক্লোজারে মাটি ফেললেও প্রকল্পের অন্য অংশে এখনো মাটি ফেলা হয়নি। ২৫ ও ২৬ নং প্রকল্পের কাজও অসমাপ্ত রয়ে গেছে। একই উপজেলার মহালিয়া হাওরের ৬নং প্রকল্পে হিজলা ও নোয়াপাড়ার মধ্যখানে মাটি পড়েনি। এই হাওরের ৭নং প্রকল্পেও একই অবস্থা। কাজ সমাপ্ত হয়নি। ৬নং প্রকল্পের সভাপতি জীবন কৃষ্ণ সরকার বলেন, আমরা দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি। এস্কেভেটর পেতে সমস্যা হওয়ার কারণে মাটি ফেলায় সমস্যা হচ্ছে। তবে কাজটি এই সপ্তাহেই শেষ করবো আশা করি।
জামালগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেকশন অফিসার (এসও) জাহিদুল ইসলাম জনি বলেন, হালির হাওরের ৫টি বাঁধের কাজ বাকি আছে। আশা করি ৩ দিনের মধ্যেই প্রকল্পগুলোর মাটির কাজ শেষ হয়ে যাবে। তবে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতে আরো ৮-১০ দিন লাগতে পারে। প্রতিদিনই আমরা হাওর ঘুরে ঘুরে কাজ দেখছি ও কাজ শেষ করতে নির্দেশনা দিচ্ছি।
তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত শনির হাওরের ১ নং প্রকল্পটি বৌলাই নদীর তীর ঘেঁষে নেওয়া হয়েছে। নদীর তীরে থাকায় বাঁধটি ঝুঁকির মধ্যে আছে। এই বাঁধে মাটি ফেললেও কমপেকশন ও দুর্বা ঘাস লাগানো হয়নি। প্রকল্পে জিওটেক্স দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো দেয়া হয়নি। শনির হাওরের ৩নং নান্টুখালি প্রকল্পের কাজও শেষ হয়নি। এই প্রকল্পের সভাপতি জিয়া উদ্দিন বলেন, আমরা মাটির কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছি। তবে এখনো ঘাস ও জিওটেক্স লাগানো যায়নি। জিওটেক্স আমরা পাইনি।
জামালগঞ্জের পাগনার হাওরের ৩৩ নং প্রকল্পেও কেবল দায়সারা মাটি ফেলা হয়েছে। ৪১ ও ৪২ নং প্রকল্পে এই হাওরের সবচেয়ে বড় ও ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার রয়েছে। বোগলাখাড়া এলাকায় বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পগুলোতে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। কিন্তু এই ক্লোজারে এখনো কমপেকশন করা হয়নি। দুর্বাঘাস, বাঁশ, বস্তা, জিওটেক্স দেওয়া হয়নি।
দিরাই উপজেলার টাংনির হাওরের ২৭ ও ২৮ নম্বর প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে এই ছুতোয় আরো ৫টি প্রকল্প বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করা হয়েছে। কালিয়াগুটা হাওরের ২৭ ও ২৮নং প্রকল্পে এখনো অর্ধেক কাজ বাকি আছে। ৬৬ ও ৬৭ নং প্রকল্পে দুর্মুজকরণ করা হয়নি, লাগানো হয়নি ঘাস। ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থাল হাওরের ৫২নং প্রকল্পের মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়নি। এই উপজেলার গোরাডুবা ও গুরমার হাওরের বাঁধগুলোর কাজও শেষ হয়নি বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
হালি ও মহালিয়া হাওরের কৃষক গোপীনাথ নোয়াগাঁওয়ের বাসিন্দা রমেন্দ্র দাস বলেন, আমাদের এই দুটি হাওরের বাধের কাজ শেষ হয়নি। কিছু মাটি ফেলা হলেও দুর্মুজ করা হয়নি। ঘাস, বাঁশ ও জিওটেক্স দেওয়া হয়নি। পাহাড়ি এলাকার বাঁধ হিসেবে এগুলোর কাজ আগে শেষ করা উচিত ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে কাজে বিলম্ব হয়েছে এবং কাজের মানও সন্তোষজনক নয়।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, হাওরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশ হলো ক্লোজার। ১৫৯টি ক্লোজারের মাটির কাজ এখনো শেষ হয়নি। দুর্মুজকরণ, দুর্বাঘাস লাগানো, জিওটেক্স, বাঁশ-চাটাই দেওয়া হয়নি। কাজে বিলম্ব ও যথাযথভাবে কাজ সম্পন্ন না করায় পাহাড়ি ঢলের ঝুঁকিতে আছে বাঁধগুলো।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ মামুন হাওলাদার বাঁধের কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়নি স্বীকার করে বলেন, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এক সপ্তাহ সময় বাড়ানোর জন্য আমরা আবেদন করেছি। এখন পর্যন্ত আমরা গড়ে ৯০ ভাগ কাজ শেষ করেছি। উল্লেখ্য, এবার হাওরে ২ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে।