আসাম রাজ্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার উত্তর-পূর্ব সীমান্ত বরাবর অবস্থিত ভারতীয় গণরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি রাজ্য। এ রাজ্য বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল বরাবর বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝখানে গারো ও খাসিয়া জাতি অধ্যুষিত মেঘালয় রাজ্যে প্রবিষ্ট রয়েছে।
আসামের সমাজ বহু শতাব্দী ধরে সংস্কৃত ভাষা ও হিন্দু ধর্মের প্রভাবাধীনে আর্যায়িত হয়ে এসেছে। তবে বাংলাদেশসংলগ্ন কয়েকটি অঞ্চল, যেমন বরাক উপত্যকা (করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও কাছাড় জেলা নিয়ে গঠিত বিস্তৃত অঞ্চল) ও বৃহত্তর গোয়ালপাড়া অঞ্চল (বৃহত্তর গোয়ালপাড়া ও ধুবরি জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চল) পূর্বকাল থেকে মুসলমান শাসনাধীনে নিপতিত হওয়ায় ইসলামায়িত হয়েছে। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় ব্রিটিশ-বার্মা যুদ্ধে বার্মা পরাজিত হলে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে আর্যায়িত আসামের বিস্তৃত অঞ্চল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন থেকে আসামের বরাক উপত্যকা এবং বৃহত্তর গোয়ালপাড়া অঞ্চলে বাংলা ভাষাভাষীদের অভিবাসন বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে আসামজুড়ে বাংলা ভাষাভাষী জনসংখ্যা বিস্তৃত হতে থাকে। অভিবাসিত এসব বাংলা ভাষাভাষীর অধিকাংশ ছিল মুসলমান আর কিছু সংখ্যক ছিল হিন্দু।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধারায় বাঙ্গলাবর্ত (বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও ঝাড়খ-) থেকে বাংলা ভাষাভাষীদের অভিবাসনের ফলে আসামের ভাষিক জনমিতিতে পরিবর্তন সূচিত হয়। আর শুরু হয় ভাষিক রাজনীতির নতুন অধ্যায়। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে আসাম অধিকারের পর ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কো¤পানি একে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত করে এবং ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষাকে আসাম প্রদেশের সরকারি ভাষা হিসেবে চালু করে। সে সময় অসমিয়া ভাষাকে বাংলা ভাষার একটি উপভাষা হিসেবে ধরা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আসামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রচলন করে। তবে আসামবাসীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সরকার ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে অসমিয়া ভাষাকে পুনরায় এ রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করতে বাধ্য হয়। সে হিসেবে প্রায় ৩৮ বছর বাংলা ভাষা ছিল আসামের সরকারি ভাষা। এর প্রতিক্রিয়ায় অসমিয়ারা বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করা শুরু করে। সেই উপেক্ষা এখনো চলছে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান হওয়ার সময় সিলেট জেলা পাকিস্তানে যুক্ত হলেও বরাক উপত্যকা ও গোয়ালপাড়া অঞ্চল ভারতের আসাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। কাজেই আসামে বাংলা ভাষা ক. বরাক উপত্যকা, খ. বৃহত্তর গোয়ালপাড়া ও গ. অন্যান্য জেলা – এ তিন অঞ্চলে তিনটি ভিন্ন ভাষা-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়।
স্বাধীনতা-উত্তর আসামে ক্ষমতায় অধ্যুষিত রাজনৈতিক শক্তি অসমিয়া ভাষিক আধিপত্যবাদের প্রতিভূ। এ রাজনৈতিক শক্তি কয়েক দশক ধরে শিক্ষা ব্যবস্থায় একচেটিয়াভাবে অসমিয়া ভাষাকে বাস্তবায়ন করে চলেছে। অর্থাৎ বাংলাসহ অন্যান্য তিব্বতীয়-বর্মী ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত ভাষাগুলোর ওপর অসমিয়া ভাষার আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে বাংলা ভাষা ও তার উপভাষাগুলো অসমিয়া ভাষার আধিপত্যের ঝুঁকিতে নিপতিত রয়েছে। কারণ অসমিয়া রাজনৈতিক শক্তি বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষাভাষীদের প্রতি কঠোর। এ কঠোরতা সৃষ্টিতে যেসব রাজনৈতিক উপাদান কাজ করেছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
১. ব্রিটিশ ও ব্রিটিশ উপনিবেশ-উত্তর ভারতে আসামের রাজনীতিতে বাংলা ভাষাভাষীদের আধিপত্য, ২. অসমিয়া ভাষাকে বাংলা ভাষার উপভাষা হিসেবে আখ্যা দিয়ে একে স্বয়ংস¤পূর্ণ ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানে বিলম্বিতকরণ, ৩. বাংলা ভাষার প্রভাবে উদ্ভূত ভাষা-সাংস্কৃতিক সংকট, ৪. বৃহৎবঙ্গ বা বৃহত্তর বাংলাদেশ তত্ত্ব, ৫. বাংলাদেশী বহিরাগত তত্ত্ব।
এ রাজনৈতিক শক্তি বাংলা ভাষা বিকাশের পথকে রুদ্ধ করতে সর্বদা তৎপর রয়েছে। সেজন্য এ শক্তি বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নানা ভাষা-রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করছে। নানা উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা ভাষার মর্যাদাকে উপেক্ষা করে অসমিয়া ভাষাকে আসাম রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা। উল্লেখ্য যে আসাম সরকার ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর আসাম রাজ্য বিধানসভায় আইন প্রণয়নের মাধ্যমে একমাত্র অসমিয়া ভাষাকে আসাম রাজ্যের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে এ উদ্যোগকে ঘিরে আসামের বাঙালিদের মধ্যে চরম অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। বরাক উপত্যকার বাঙালিরা এ উদ্যোগের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সে সময় করিমগঞ্জ (উত্তর) আসনের বিধায়ক রণেন্দ্র মোহন দাস বিধান সভায় এ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বলেন যে এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ভাষা (অসমিয়া) দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেয়া চলবে না। তবে ওই বছর ২৪ অক্টোবর তারিখে এ আইন পাস হয়ে যায়। প্রতিবাদে বরাক উপত্যকায় ব্যাপক ভাষা অধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। আন্দোলন সংঘটনের প্রক্রিয়ায় ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয় ‘কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ’। কিন্তু এ সময় বৃহত্তর গোয়ালপাড়া ও অন্যান্য অঞ্চলে বাংলা ভাষার পক্ষে অনুরূপ ভাষা আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখা যায়নি। একটানা চার মাস আন্দোলন চলার একপর্যায়ে আসাম সরকার দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন থামাতে প্রয়াসী হয়। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে তারিখে সর্বাত্মক হরতাল চলাকালে এক হত্যাকা- সংঘটিত হয়। এ হত্যাকা-ে ১১ জন আন্দোলনকারীকে প্রাণ দিতে হয়। এ হত্যাকা-ের পর আসাম সরকারের টনক নড়ে। ফলে আসামের রাজ্য সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। তবে সেই আন্দোলনের পর থেকে আসামসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ১৯ মে ‘বাংলা ভাষা শহীদ দিবস’ পালন হয়।
এভাবে বরাক উপত্যকা অঞ্চলে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে আসামের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু বৃহত্তর গোয়ালপাড়া অঞ্চলে বাংলা ভাষার অধিকার প্রশ্নে কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। তার কারণ বৃহত্তর গোয়ালপাড়া ও তার সন্নিহিত জেলাগুলোর বাংলা ভাষাভাষীদের অধিকাংশই ধর্মে মুসলমান। আর এসব মুসলমানকে প্রায়ই বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করে, বাংলাদেশে বিতাড়ন করার ভয় দেখানো হয়ে থাকে। এভাবে গোয়ালপাড়ার বাংলা ভাষাভাষীরা বহিরাগত ইস্যুতে কাবু হয়ে পড়ায়, তারা তাদের ভাষা অধিকার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না। সে কারণে বৃহত্তর গোয়ালপাড়িয়ারা বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের দাপ্তরিক কাজকর্ম ও শিক্ষা গ্রহণের মতো বিষয়গুলো অসমিয়া ভাষায় পরিচালনা করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলা ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও তারা বাংলা ভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সার্বিকভাবে অসমিয়া ভাষায় অপবর্তিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তারা বাংলা ভাষাকে হারিয়ে ধীরে ধীরে অসমিয়া ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীতে লীন হয়ে যাচ্ছে।
[ড. এবিএম রেজাউল করিম ফকির: অধ্যাপক, সুলতান ইদ্রিস শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়া এবং ভূতপূর্ব পরিচালক আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]