বিশেষ প্রতিনিধি ::
চারদিকে শিমুল ফুল থেকে থেকে দোল খাচ্ছে বসন্তের পাগলা হাওয়ায়; সে মায়ায় চোখ না জুড়াতেই ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসা মনোমুগ্ধকর কোকিলের কুহুতান জানান দিচ্ছে বসন্ত এসে গেছে। ¯িœগ্ধ বাতাসে হালকা ঠা-ার অনুভূতি, একপাশে পাহাড় আর মাঝখানে যাদুকাটা নদীর স্থির ঢেউ। অন্যদিকে নতুন গজানো সবুজ পাতায় যেন ফাগুনের আগুন ধরেছে তাহিরপুরের হাজী জয়নাল আবেদীন শিমুল বাগানে। বসন্তের এমন আবহেই পয়লা ফালগুনে সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমি সারাদেশের বসন্তের হটস্পট হিসেবে পরিচিত শিমুলবাগানে বসন্ত উৎসব উদযাপন করেছে। ভালোবাসার বসন্তদিনে নাচ, গান ও আলোচনায় বুঁদ ছিলেন দর্শনার্থীরা। অনুষ্ঠানে প্রায় দুইশজন শিল্পী নাচ ও গান পরিবেশন করেন।
প্রায় দুই হাজার গাছের শিমুল বাগানটির অবস্থান তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তগ্রাম মানিগাঁওয়ে বিস্তীর্ণ বালুঘেরা প্রকৃতিসুন্দর স্থানে। প্রতি বছরের মতো এবারও ভালোবাসা দিবস আর ফালগুন উদযাপন করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন শিমুল বাগানে।
বুধবার সকাল থেকেই দর্শনার্থীদের পদচারণার আরও রঙিন হয়ে ওঠেছিল শিমুল বাগান। যাদুকাটা পাড়ে শিমুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ। শত শত শিমুলও দোল খেয়ে বাসন্তী অভিবাদন জানায় তাদের। বসন্তরাঙা ভালোবাসার দিনের প্রিয় মানুষের হাতে হাত রেখে মনের অজান্তেই অনেকে গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠেন প্রেমের গান।
অনেকে আবার প্রাণ খুলে গলায় ধরেন এই অঞ্চলের বাউল মহাজন শাহ আবদুল করিমের গান ‘বসন্ত বাতাসে সইগো…’। এছাড়াও বসন্ত উৎসবে আসা শিল্পীরা বসন্তের গান পরিবেশন করেছেন।
এই শিমুল বাগান তৈরির গল্পে বাগানের স্বত্ত্বাধিকারী রাখাব উদ্দিন জানান, দুই যুগেরও বেশি আগে তাহিরপুর উপজেলার সোহালা গ্রামের শিক্ষানুরাগী ও বৃক্ষপ্রেমি আমার বাবা জয়নাল আবেদীন বাড়ি থেকে বেরিয়ে মানিগাঁওয়ের যাদুকাটা নদীর দক্ষিণে বিস্তীর্ণ বালুময় প্রান্তরে দুটি শিমুল গাছ দেখেন। বালু ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে এসেছে নয়নাভিরাম স্বর্গীয় বৃক্ষ। ন্যাড়া মাথায় শিমুলের ফুল বসন্তের পাগলা হাওয়ায় দুলছে। আর ডালে লেজ দোলাচ্ছে কিছু পাখি। এই দৃশ্য দেখে বৃক্ষপ্রেমি জয়নাল মনস্থির করেন, পুরোটা জায়গা কিনে শিমুল বাগান করবেন। যেই ভাবনা, সেই কাজ। তিনি প্রায় ৩৩ একর জায়গা কিনে পরিচিত উদ্ভিদ বিশারদ কয়েজনের পরামর্শ নিয়ে সংগ্রহ করেন শিমুল গাছের চারা। সারি সারি গর্ত খুঁড়ে শুরু হয় তার শিমুল গাছ লাগানোর কর্মযজ্ঞ।
বালুময় প্রান্তরে লাগিয়ে দেন দুর্বাঘাস। নাওয়া-খাওয়া ভুলে রাতদিন বাগানের তদারকি শুরু করেন। তার পুরোটা সময়ই কাটতো বাগান ঘিরে। পুরো জায়গায় গাছ লাগানো শেষ হলে সারি সারি শিমুল গাছ দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায় তার। বৃক্ষগুলোতে বাঁচিয়ে রাখতে দুর্গম মরুময় প্রান্তরে পানি, গোবর সংগ্রহ করতে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করেন। পরামর্শ নেন কিভাবে গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখা যায়। এক বছর পরই গাছের ডালপালায় ছাতার মতো ছায়াময় হয়ে ওঠে পুরো বাগান। ধিরে ধিরে গাছগুলো বড় হতে থাকলে, প্রাণ জুড়ায় জয়নাল আবেদীনের। অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে ওঠে তার মন। প্রতিদিন ঘুম ভাঙতেই বাড়ি থেকে বাগানে ছুটে আসতেন।
রাখাব উদ্দিন আরো জানান, ২০০৬ সালে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় আমার বাবা জয়নাল আবেদীন প্রাণ হারান। এর মধ্যে শিমুল গাছগুলো বড় হয়ে গেছে। তার শখের বাগানে ফালগুনে হাজার হাজার মানুষ শিমুলের সৌন্দর্য উপভোগ করছে, এই দৃশ্য দেখে যেতে পারেন নাই তিনি। অথচ এটা দেখার জন্যই তিনি এই বাগান করেছিলেন।
২০১১-২০১২ সালের দিকে শিমুল বাগানে ফুল ফুটতে শুরু করে বলে জানান বাগানের আরেক স্বত্ত্বাধিকারী আফতাব উদ্দিন। বলেন, “দুর্গম যোগাযোগহীন অজপাড়াগাঁয়ে বসন্ত রঙে আগুন হয়ে ওঠে বাগানটি। পত্রহীন ন্যাড়ামাথার ডালগুলোতে শুধুই লাল শিমুলের বিস্তার। কিন্তু যোগাযোগ বিড়ম্বনার কারণে প্রকৃতিপ্রেমি বা ভ্রমণার্থীরা এসে দুর্ভোগে পড়েন। তবে আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সামান্য রিফ্রেশমেন্টের আয়োজন করেছি। “২০১৩-২০১৪ সালের দিকে জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে শিমুল বাগান নিয়ে প্রতিবেদন হয়। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ বাগানের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিদেশের প্রকৃতিপ্রেমিদের নজর কাড়ে। তারাও পরিবার নিয়ে ছুটে আসেন বসন্তকালে, ভালোবাসার দিনে হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করেন।” জেলা শিল্পকলা একাডেমি তাদের সঙ্গে কথা বলে শিমুল বাগানে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেছে বলে জানান তিনি।
বসন্ত উৎসবের জন্য হলুদ আভায় তৈরি করা হয়েছিল আকর্ষণীয় মঞ্চ। এই মঞ্চে বসন্ত বরণের গান, নাচ, কবিতা আবৃত্তি ও আলোচনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। উন্মুক্ত এ অনুষ্ঠানটি দেখতে সংস্কৃতি অনুরাগী ও দর্শনার্থীরা ভিড় করেছিলেন। সারাদিন দর্শনার্থীরা অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন।
বাগান ঘুরে দেখা গেছে, ভ্রমণার্থীদের আনন্দ দিতে ব্যক্তি উদ্যোগে বাগানে ঘোড়া ও সাইকেল চড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে; আছে নাগরদোলাও। অনেকে ক্যাম্প করে রাতেও অবস্থান করেন শিমুল বাগানে।
সুনামগঞ্জ জেলা কালচারাল অফিসার আহমেদ মঞ্জুরুল হক চৌধুরী পাভেল বলেন, “শিমুল বাগানের বসন্ত উৎসব উপভোগ করতে সারাদেশ থেকে লোকজন ছুটে এসেছেন। আমরা এই অঞ্চলের মহাজনদের বিভিন্ন সৃষ্টি পরিবেশনা করেছি। নাচ, কবিতা ও গানে গানে বসন্তকে স্বাগত জানাতে প্রায় ২০০জন শিল্পী তাদের পরিবেশনা পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানে বিভাগীয় কমিশনার স্যার, ডিসিস্যারসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।