সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯২ সালে। ১৯১৭ সালে নগরের টিলাগড় এলাকায় প্রায় দেড় শ একর জায়গা নিয়ে বর্তমান ঠিকানায় স্থানান্তরিত হয় ঐতিহ্যবাহী এ কলেজ।
পরবর্তী সময় কলেজের সামনের দিকেই নির্মিত হয় এক তলা দুটি ভবন। কাঠের নল-বর্গার সঙ্গে চুন-সুরকির প্রলেপ আর টিনের ছাদের বিশেষ নির্মাণশৈলীর এসব ভবন স্থাপত্যকলায় ‘আসাম প্যাটার্ন’ হিসেবে পরিচিত, তবে সংরক্ষণের অভাবে বর্তমানে ভবন দুটি ধ্বংসের পথে।
কলেজ সূত্রে জানা যায়, সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এক স্থাপত্যশৈলী হলো আসাম প্যাটার্ন। ভূমিক¤প প্রবণ সিলেট অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে এ বিশেষ নির্মাণশৈলীতে ভবন নির্মাণ করা হত।
নির্মাণের শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া ও ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থেকে ভবনগুলোকে প্রতœতত্ত্ব নিদর্শন দাবি করে সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশকর্মী, সচেতন নাগরিক এবং কলেজটির সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা, তবে কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, এ ভবনগুলো আর সংস্কারের পর্যায়ে নেই।
সিলেটে শতবর্ষী ভবন রক্ষার দাবি :
এমসি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, ভাষাসৈনিক অধ্যাপক মো. আবদুল আজিজ রচিত ‘মুরারিচাঁদ কলেজের ইতিকথা’ বই থেকে জানা যায়, ১৯২৬ সালে এই ভবন দুটিতে বিজ্ঞান ক্লাস শুরু হয়। তাই সংশ্লিষ্টদের ধারণা ১৯২১-১৯২৫ সালের মধ্যে নান্দনিক নকশার এই ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়। যা ওই সময়কার স্থাপত্য কলার নিদর্শন বহন করে আসছে। সে হিসেবে এই ভবনগুলো নির্মাণের শতবর্ষ পেরিয়েছে।
সম্প্রতি এমসি কলেজে গিয়ে দেখা যায়, কলেজের ফটক পেরিয়ে দুটি সমন্তাল রেখার মতো ভবন দুটো। ইতোমধ্যে ভবনগুলোর অনেক খুঁটি ভেঙে পড়েছে। স্থানে স্থানে দেয়ালেও ভাঙন দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া চালের টিন ও কাঠ জরাজীর্ণ হয়ে ভেঙে পড়ছে। ফলে যেকোনো সময় ভবনগুলো ভেঙে পড়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী এ ভবনগুলো রক্ষার দাবিতে মাঠে নেমেছেন কলেজের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী, পরিবেশকর্মী ও সচেতন নাগরিকরা। স্থাপনাগুলো রক্ষায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রথমে আহ্বান জানান কলেজটির সাবেক শিক্ষার্থী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গোলাম সোবহান চৌধুরী।
গত ৮ জানুয়ারি গোলাম সোবহান চৌধুরী তার ফেসবুকে লেখেন, ব্রিটিশ আমলে আসাম প্রদেশের অন্যতম প্রধান কলেজ ও দেশের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজের চারটি শতবর্ষী ভবন সংরক্ষণ ও রক্ষায় আশু উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। ঐতিহ্যবাহী এবং কালের স্মৃতি বহনকারী ১৯২১ সালে আসাম প্যাটার্নে নির্মিত বাংলা ও সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের পুরোনো ভবন, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কলেজ মাঠের গ্যালারি ও অধ্যক্ষের বাসভবন, এগুলো শতবর্ষী এবং ‘পুরাতাত্ত্বিক বিভাগের’ স¤পদ। এগুলো রক্ষায় আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু অযতেœ ও অবহেলায় পড়ে আছে। এই অবস্থায় সিলেটের ঐতিহ্যের স্মারক এমসি কলেজের শতবর্ষী ভবনগুলো রক্ষার্থে কলেজের বর্তমান ও সাবেক ছাত্র-ছাত্রী, সিলেটের সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে গোলাম সোবহান চৌধুরী বলেন, এমসি কলেজের ঐতিহ্যবাহী আসাম প্যাটার্নের ভবন দুটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং বিদ্যাচর্চা অনুশীলনের ঐতিহাসিক একটি নিদর্শন। পাশাপাশি ভবন দুটি স্থাপত্য বিভাগের অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের একটি পাঠ উপকরণ হিসেবে গণ্য করা যায়। কারণ এর মূল নকশা নির্মাণশৈলী বর্তমান স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভবনের নকশা তৈরির বিবর্তনের ধারাটির একটি ধারণা দেবে। একে অক্ষুণœ রাখা উচিত।
এই ভবনগুলো রক্ষার দাবিতে গত ৩ ফেব্রুয়ারি এমসি কলেজের পুকুরপাড়ে একটি সভা করেন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। এতে সিলেটের নাগরিক সমাজের অনেকেই অংশ নেন।
এই সভায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সভাপতি অধ্যাপক জামিলুর রহমান বলেন, এই সব পুরোনো স্থাপনার সঙ্গে আমাদের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এগুলো ভেঙে ফেললে স্মৃতি হারিয়ে যাবে। স্মৃতি হারিয়ে গেলে মানুষের আর থাকে কি?
তিনি বলেন, ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে কোনো উন্নয়ন হতে পারে না। বরং উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বার্থেই আমাদের ঐহিত্য ও কৃষ্টিকে ধরে রাখতে হবে। এই ভবনগুলো আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। এগুলো এভাবে ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। এগুলো সংস্কারের ইচ্ছে ও উদ্যোগ থাকলে অর্থের অভাব হবে না।
এ বিষয়ে এমসি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল আনাম রিয়াজ বলেন, এই ভবনগুলো এখন আর সংরক্ষণ করার মতো পর্যায়ে নেই। প্রতœতত্ত্ব বিভাগও এটা আর সংরক্ষণ করতে পারবে না বলে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন। কারণ এই ভবন তৈরিতে যে কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে, সবগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। সংরক্ষণ করার মতো না। তা ছাড়া এগুলো সংস্কারের জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দও নেই।