1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ০৬:৩৮ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

মহিষ বিচরণে টাঙ্গুয়ার হাওরের ক্ষতি

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

শামস শামীম ::
সুনামগঞ্জের রামসার সাইট খ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওর আন্তর্জাতিক একটি সংরক্ষিত এলাকা। জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ২০০৩ সাল থেকে হাওরটি সংরক্ষিত হলেও হাওরের সংরক্ষিত এলাকায় মহিষপাল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মহিষের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে ধ্বংস হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের হিজল করচ ও নলখাগড়ার চারা, কচ্ছপ এবং সরীসৃপের ডিম, পাখির বাসাসহ স্থলজ ও জলজ বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্য। টাঙ্গাইল ও ময়মনিসংহ এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র ভাড়ায় হাওরের কান্দায় (উঁচুভূমি) টাকার বিনিময়ে এগুলো চরতে দিচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। ওই চক্র পরিবেশ বিধ্বংসী কাজের সুযোগ করে দিয়ে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। প্রায় একমাস ধরে হাওরের কান্দা-জাঙ্গালে (ঘাস ও বনে আবৃত উঁচু সবুজভূমি) মহিষের পাল ছেড়ে এভাবেই সংরক্ষিত এলাকাকে গোচারণ ভূমি বানিয়ে ফেলা হয়েছে। ঘাস লতা-পাতা খাওয়ার নামে বিনাশ করছে পাখির বাসা, ডিম, কচ্ছপ ও সরীসৃপের ডিম। এদিকে এ ঘটনাকে টাঙ্গুয়ার হাওরের বায়োডাইভারসিটির জন্য বিরাট হুমকি বলে মতামত দিয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রতিবেশ কমিটি।
টাঙ্গুয়ার হাওরের বিভিন্ন গ্রামের কৃষক ও সচেতন লোকজন জানান, শীত মওসুমে টাঙ্গুয়ার হাওরের জাঙ্গাল- কান্দা (ঘাস ও বনে আবৃত উঁচু সবুজ ভূমি) জেগে ওঠে। শীত মওসুমে এই স্থানটি পুষ্টিকর সবুজ ঘাস ছেয়ে যায়। এই সুযোগে প্রতি বছরই টাঙ্গাইল ও ময়মনিসংহ এলাকার মহিষের খামারিরা মহিষের দল নিয়ে স্থানীয় একটি প্রভাবশালীদের সঙ্গে চুক্তি করেন। স্থানীয় চক্র মহিষের খামারিদের কাছ থেকে এককালীন অর্থ নিয়ে জাঙ্গাল কান্দায় ঘাস খাওয়ানোর অনুমতি দিয়ে বিভিন্ন কান্দায় মহিষ চারণভূমি হিসেবে গড়ে তোলে। এবারও মন্দিআতা, জয়পুর ও ছিলাইন তাহিরপুরের একটি চক্র জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে হাওরটির রূপাভূঁই কান্দা, রৌয়া কান্দা, জয়পুর, ছিলাইন তাহিরপুর কান্দা, ফইল্যার বিলে প্রায় কয়েকশ মহিষ নিয়ে এসেছে। এগুলো প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কান্দায় ছেড়ে ঘাস খাওয়াচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে হাওরের বিভিন্ন ধাইর (নালা) ছেড়ে দিচ্ছে পানি খাওয়াতে। এতে জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে।
স্থানীয়রা জানান, মহিষের চারণ এলাকা রামসার সাইট হিসেবে সংরক্ষিত। এখানে পরিবেশ বিনাশী এমন কার্যক্রম রামসার নীতি অনুযায়ী আইনত কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও উপজেলা প্রশাসন যাদেরকে সংরক্ষণে যুক্ত রেখেছে তারাই এসব ঘটনায় জড়িত বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। যার ফলে প্রশাসনকেও উল্টো বুঝিয়ে তারা অভিযান না চালাতে নিরুৎসাহিত করছে। মন্দিআতা এলাকার কয়েকজন এ ঘটনায় জড়িত বলে একাধিক কৃষক অভিযোগ করেছেন। তবে সম্প্রতি দুটি অভিযানে কিছু মহিষ আটক করা হয়েছিল। মুচলেকায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় কৃষক ও জনপ্রতিনিধিরা জানান, গত ৩১ জানুয়ারি মহিষের বিরাট পাল দেখে স্থানীয় কৃষকরা উপজেলা প্রশাসনকে খবর দেন। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসাদুজ্জামান রনি ঘটনাস্থলে পৌঁছে ৯টি মহিষ আটক করেন। প্রশাসনের আসার খবর পেয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর ব্যবস্থাপনায় যুক্ত কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন সুবিধাভোগী মহিষ ভাড়ায় আনা লোকদের বিষয়টি জানিয়ে দিলে তারা গহীন বাগের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলে মহিষের দল। আটককৃত মহিষগুলো টাঙ্গুয়ার হাওর সংরক্ষণে নিয়োজিত কেন্দ্রীয় কমিটির জিম্মায় রাখা হয়। কিন্তু পরদিনই মহিষগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও এই হাওরের বড় বন্দ, টানের বন্দ, বিয়াসখালি, গোলডোবা, ইকইরদাধাইড়, বাঘমারাসহ বিভিন্ন স্থানের কান্দায়ও মহিষের দল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। এদিকে গত ৩১ জানুয়ারির পাশাপাশি গত ৫ ফেব্রুয়ারিও অভিযান চালিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটনবাহী পানসী ভোটের পরিচালক মঈনুদ্দিন বলেন, মাস খানেক ধরে দেখছি হাওরের বিভিন্ন কান্দা ও জাঙ্গালে মহিষকে ঘাস খাওয়ানো হচ্ছে। প্রতিদিন ৩-৪শ মহিষ ঘাস খাচ্ছে।
লামাগাঁও গ্রামের কৃষক ফজলু মিয়া বলেন, মহিষের পায়ে পিষ্ট হয়ে হাওরের মূল্যবান স্থলজ ও জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। আমরা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানালে প্রশাসন কয়েকটি মহিষ আটকও করেছিল। পরদিন থেকে আবার সংরক্ষিত এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এসব মহিষ। তিনি বলেন, বিশালাকৃতির মহিষের পায়ে পিষ্ট হয়ে কান্দায় প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া বিভিন্ন মূল্যবান বৃক্ষের চারা, সরীসৃপ ও পাখির ডিম, কচ্ছপের ডিম নষ্ট হচ্ছে। পানিতে নেমেও জলজ জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস করছে তারা।
টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের গ্রাম পাটাবুকা গ্রামের পরিবেশকর্মী রিপচান হাবিব বলেন, স্থানীয় কিছু দালাল সরকারি কান্দা ভাড়া দিচ্ছে মহিষের মালিকের কাছে। তারা সামান্য টাকা পেয়ে একটি আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকার পরিবেশ নষ্ট করছে। হাওরের স্থলজ ও জলজ উদ্ভিদবৈচিত্র্যও নষ্ট করে দিচ্ছে মহিষের দল। তিনি বলেন, মহিষ শুধু চারণভূমিতেই চরছেনা জলেও নেমে জলজজীববৈচিত্র্য নষ্ট করছে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রকৃতি পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন সময়ে কাজে যুক্ত সিএনআরএসের প্রতিবেশ প্রকল্পের সাইট অফিসার ইয়াহইয়া সাজ্জাদ বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের যেসব এলাকায় মহিষ ছড়ানো হচ্ছে সেগুলো ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া। এই এলাকায় দেশিয় প্রজাতির পাখি ডিম পারে। সরীসৃপ, কচ্ছপ, পোকা মাকড় ডিম পাড়ে। প্রাকৃতিকভাবে জলাবন জন্ম নেয়। কিন্তু শত শত মহিষের পায়ে পিষ্ট হয়ে এসব জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। তিনি জানান, স্থানীয় কিছু লোকজন মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে মহিষ নিয়ে এসে এভাবে প্রকৃতি বিনাশ করছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে সচেতন মানুষদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, ২০০৩ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রকৃতি ফিরিয়ে আনতে আইউসিএনসহ অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে। কিন্তু স্থানীয়দের সম্পৃক্ততার অভাবে প্রকৃতি পুনরুদ্ধার সম্ভব হচ্ছেনা। এই মহিষ চারণ হাওরের জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি স্বরূপ হিসেবে এলাকাবাসীই চিহ্নিত করেছেন। গত বছরের মার্চ মাসে স্থানীয়দের নিয়ে একটি প্রতিবেশ কমিটি এই মতামত দিয়েছিল।
তাহিরপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসাদুজ্জামান রনি বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বিভিন্ন এলাকা থেকে মহিষের দল এনে ঘাস খাওয়ানো হচ্ছে। এত পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে। আমরা গত কয়েকদিন আগে মহিষ চারণের খবর পেয়ে অভিযান চালিয়েছি। কয়েকটি মহিষ আটক করে আমাদের টাঙ্গুয়ার হাওর সুরক্ষা কেন্দ্রীয় কমিটির জিম্মায় ছেড়ে দিয়ে এসেছি। গত সোমবারও অভিযান চালিয়েছি। হাওর থেকে ৫৬টি চায়না দুয়ারি জাল জব্দ করে পোড়ানো হয়েছে। অভয়াশ্রমের ভিতর মাছ ধরার অভিযোগে তিনজনকে ৫শ টাকা করে জরিমানা ও তিনদিনের জেল দেওয়া হয়েছে। তবে গত ৩১ জানুয়ারি অভিযান চালানোর কারণে আজ মহিষ পাইনি আমরা।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com