মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ- তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং আরাকান আর্মি’র সমন্বয়ে গঠিত ‘ব্রাদারহুড অ্যালাইয়েন্স’র ‘অপারেশন ১০২৭’ কাছে মিয়ানমারের মহাপরাক্রমশালী সেনাবাহিনীর নিয়মিত ‘মার খাওয়া’র খবর আমরা পাচ্ছি।
বিশেষ করে, আরাকান আর্মি একটার পর একটা মিয়ানমারের মিলিটারি ঘাঁটি দখল করে নিজেদের করতলগত করছে – এই রকম খবর আমাদের জন্য যুগপৎ আনন্দের এবং উদ্বেগের। আনন্দের এই কারণে যে, আমরা আশা করছি (বিশেষ করে অনেক আশাবাদী নিরাপত্তা বিশ্লেষক) যদি আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যকে নিজেদের দখলে নিতে পারে, একইভাবে মিয়ানমারের অন্যান্য স্টেটে রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপগুলোর কাছে সেনাবাহিনীর পরাজয় ঘটে এবং এর প্রতিফলন হিসেবে মিয়ানমারে নতুন করে গণতন্ত্রায়ণ ঘটে, তাহলে মিয়ানমারে বসবাসরত রোহিঙ্গারা পূর্বের তুলনায় খানিকটা ভালো অবস্থায় যাবে।
বাংলাদেশে বসবাসকারীদের রাখাইনে ফেরত পাঠানোর পথটাও খানিকটা সুগম হবে। (যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে আশাবাদী মানুষ কিন্তু এই ব্যাপারে আমি আশাবাদী নই)।
অন্যদিকে উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, যদি রাখাইনে আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং রাখাইনে যদি একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়, তখন রাখাইনে বসবাসকারী প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার জোর চেষ্টা করবে।
তখন রোহিঙ্গাদের এই নতুন অনুপ্রবেশ ঠেকানো বাংলাদেশের জন্য একটা বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যদি কোনো কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছে আরাকান আর্মির পরাজয় ঘটে (সেই সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না), তখনো আরাকান আর্মির প্রতি সমর্থন থাকার কারণে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নতুন করে দমনপীড়ন চালাবে। তখন রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গারা নিজেদের ‘প্রাণ’ বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে নতুন করে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করবে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে বর্বর জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে, তাতে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সমর্থন কারার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আরাকান আর্মির প্রধান জেনারেল তোয়ান মারত নাইং ২০২২ সালে দেওয়া দুটি সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন এবং তারা যদি আরাকানে নিয়ন্ত্রণাধিকার পান তাহলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একসাথে কাজ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।
রোহিঙ্গারাও এই অভিপ্রায়কে স্বাগত জানায়। যদিও রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে আরাকান আর্মিকে সমর্থন জানানো কিংবা না-জানানোর কোনো ফর্মাল ফোরাম, বডি বা নেতৃত্ব নেই। তথাপি জনপ্রিয় বোঝাবুঝি হচ্ছে, রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির লড়াইয়ে রোহিঙ্গাদের সমর্থন আরাকান আর্মির পক্ষে।
এছাড়া ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে বর্বর জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে, তাতে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সমর্থন কারার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। কোনো কারণে যদি আরাকান আর্মি হেরে যায়, তাহলে রোহিঙ্গাদেরও এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে। তখন নতুন করে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানোই হয়ে যাবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ৮ ডিসেম্বর ২০২০ অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে নতুন করে নির্বাচিত পার্লামেন্টের সদস্যদের শপথ গ্রহণের দিন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ সামরিক জান্তা রক্তপাতহীন সামরিক ক্যু’র মাধ্যমে মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।
গ্রেফতার করা হয় ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চিকে। সাথে তৎকালীন মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতিসহ নবনির্বাচিত এনএলডি শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাইকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬২ সাল থেকে দীর্ঘ সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট মিয়ানমারের গণতন্ত্র ২০১১ সালে যখন প্রথমবারের মতো মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে এবং সেই নিঃশ্বাসের পরিব্যাপ্তি ঘটে ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত, তখন নতুন করে গণতন্ত্রের গলা টিপে সামরিক বাহিনী পুনরায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। কিন্তু ততদিনে মিয়ানমারের জনগণ গণতন্ত্রের মর্মার্থ খানিক বুঝতে শিখেছে এবং গণতন্ত্রের খিদায় খানিকটা ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছে।
সামরিক বাহিনীর শাসন দিয়ে তো গণতন্ত্রের খিদে মেটানো যায় না। ফলে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর এবারের ক্যু মিয়ানমারের সাধারণ জনগণ একেবারেই গ্রহণ করেনি। সাধারণ জনগণ এই সামরিক ক্যুকে মেনে নেয়নি। বরং তীব্র প্রতিবাদ ও মারমুখী প্রতিরোধের ভেতর দিয়ে সামরিক বাহিনীর অবৈধ দখলদারিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের ৩ বছর পূর্ণ হলো। এর মধ্যে জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। এনএলডি’র নবনির্বাচিত পার্লামেন্টের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) নামে একটি ছায়া সরকার যা ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে।
পৃথিবীর প্রায় ছয়টি দেশে এনইউজি তাদের কনস্যুলেট অফিস স্থাপনের অনুমতি পেয়েছে। এনইউজি’র প্রতিনিধিরা পৃথিবীর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করছে। এনইউজি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে মোকাবিলার জন্য গড়ে তুলে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)।
সামরিক বাহিনীর শাসন দিয়ে তো গণতন্ত্রের খিদে মেটানো যায় না। ফলে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর এবারের ক্যু মিয়ানমারের সাধারণ জনগণ একেবারেই গ্রহণ করেনি। এই পিডিএফের নেতৃত্বে দীর্ঘ বছর ধরে নিজেদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষা এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াইরত বিভিন্ন রেজিস্ট্যান্ট আর্মড গ্রুপগুলো সমন্বয় করে জান্তা বিরোধী তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। ফলে, সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স মুভমেন্টের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে পিডিএফ সমন্বয়ে মিয়ানমারের বিভিন্ন আঞ্চলিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপগুলো।
দেশের অভ্যন্তরে জনগণের সমর্থন, দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং বিভিন্ন রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপগুলোর সশস্ত্র লড়াই মিলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার মসনদ এখন বেশ খানিকটা নড়বড়ে। এরই মধ্যে হাজার হাজার সৈন্য সেনাবাহিনী ত্যাগ করে জনগণের কাতারে সামিল হয়েছে এবং জান্তা বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছে।
প্রায় ৫ লাখ সৈন্যের মিয়ানমারের শক্তিশালী সেনাবাহিনী এখন প্রায় ১,৫০,০০০-১,৬০,০০০ এ এসে দাঁড়িয়েছে। এসব কিছুর বিবেচনায় অনেকে মনে করছেন মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর পতন কেবলই সময়ের ব্যাপার। কিন্তু আমি তা মনে করি না।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এত সহজে হার মানার কথা নয়। তবে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ আরও বিশেষ একটি কারণে। যদি কোনো কারণে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়, তখন আরাকান আর্মির প্রায় ৩০,০০০ প্রশিক্ষিত বাহিনী পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারে।
যদি আরাকান আর্মি হেরে যায়, তখন তারা সবাই যে সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে তা নয়; বরং নিকটবর্তী সীমান্ত হিসেবে বাংলাদেশে পালিয়ে অনুপ্রবেশ করার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। ফলে, তা হবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
অনেকে বলেন, রাখাইনে কী হচ্ছে এতে বাংলাদেশের ‘কী যায় আসে’! কিন্তু আমি মনে করি, রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির চলমান লড়াইয়ের ফলাফল বাংলাদেশের জন্য অনেক কিছু ‘আসে’, কিন্তু ‘যায়’ না।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।