জয়ন্ত সেন ::
শাল্লায় একদিকে চলছে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ সংস্কারের কাজ। অন্যদিকে কাজ চলছে ১৯ কিলোমিটার দিরাই-শাল্লার আঞ্চলিক পুরনো মহাসড়ক কেটে ৬২৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে আঞ্চলিক সড়কটির সেতু নির্মাণ। যে সমস্ত জায়গায় সেতু নির্মাণকাজ চলছে, সেই সমস্ত জায়গায় ফসলরক্ষার জন্য কোনো প্রকল্পই দেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ফলে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে ছায়ার হাওরে অবস্থিত ৪ জেলার বোরো ফসল।
সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ প্রান্তের শেষ সীমানায় অবস্থিত ছায়ার হাওর। ওই হাওরে শাল্লা উপজেলা ছাড়াও বোরো ফসল রয়েছে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুড়ি ও হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার। সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের অদূরদর্শীতা এবং সমন্বয়হীনতার কারণে এই বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল এখন চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা।
বুধবার (৩১ জানুয়ারি) সরেজমিনে দেখা যায়, দিরাই-শাল্লা আঞ্চলিক সড়কের বেশকিছু স্থানে সেতু নির্মাণের কাজ চলছে। পুরনো সড়ক কেটে সেতু তৈরির কারণে ছায়ার হাওরের বোরো ফসল অনেকটাই অরক্ষিত। শাল্লা সদর সংলগ্ন সুখলাইন গ্রামের পাশে তৈরি হচ্ছে ২৭ মিটারের একটি সেতু। নির্মাণাধীন সেতু থেকে ১০০ মিটার দূরে রয়েছে দাঁড়াইন নদী। নদীর তলদেশ এমনিতেই ভরাট হয়ে গেছে। নদী খনন না হওয়ায় সংকুচিত হয়ে পড়েছে নদীর দুই পাড়। নদীর পাড়ে সায়েরী গাছ নামক একটি দেবস্থানও আছে। সায়েরী গাছের উত্তর দিকের স্থানটি বেশ নিচু। দেখতে খালের মত। তাও আবার ওই স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীতে জোয়ার আসলে এ ভাঙা জায়গা দিয়ে সরাসরি নির্মাণাধীন সেতুর নিচ দিয়ে হাওরে পানি প্রবেশ করবে।
অন্যদিকে, বাহাড়া ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রাম ও গিরিধর উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম দিকে একই ধরনের আরেকটি ব্রিজের নির্মাণকাজ চলছে। সেখানেও নোয়াগাঁও গ্রামের সেচ পা¤েপর নিচু স্থান দিয়ে বিদ্যালয়ের কালভার্ট হয়ে পানি ঢুকবে ছায়ার হাওরে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, এই দুটি নির্মাণাধীন ব্রিজের জন্য খাল করা জায়গা দিয়ে হাওরে প্রবেশ করবে পানি। মুহূর্তেই তলিয়ে যাবে ৪ জেলার বোরো ফসল।
সুখলাইন গ্রামের বাসিন্দা কৃষক মৃদুল চন্দ্র দাশ বলেন, বিষয়টি খাল কেটে কুমির আনার মতই! যেখানে ব্রিজ করা হচ্ছে – এর পূর্বদিকে একটি খালের মত জায়গা আছে। যেদিক দিয়ে বর্ষায় নৌকা চলাচল করে। এখন সড়ক কেটে আমার গ্রামের পাশে ব্রিজ তৈরি করা হচ্ছে। এখানে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কোনো পিআইসি দেওয়া হয়নি। যেকারণে নদীতে পানি বাড়লেই তলিয়ে যাবে ছায়ার হাওরের পুরো ফসল।
এ বিষয়ে হাওর বাঁচাও আন্দোলন শাল্লা উপজেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তরুণ কান্তি দাশ বলেন, একদিকে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে বাঁধ মেরামতে। আবার আঞ্চলিক সড়ক নির্মাণকাজ করতে গিয়ে কাটা হলো পুরানো সড়ক। এতো দেখছি খাল কেটে কুমির ডেকে আনা! যেসমস্ত জায়গায় সেতু তৈরি করা হচ্ছে – সেই সমস্ত জায়গায় দ্রুত পিআইসি (প্রকল্প) দেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় নদীতে সাধারণ জোয়ারেই হাওরডুবির ঘটনা ঘটতে পারে। আর এখানে ব্রিজ দরকারই ছিল না বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে সুনামগঞ্জ পওর বিভাগ ২-এর দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী শামসুদ্দোহার মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে কল রিসিভ করেননি তিনি।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও কাবিটা স্কিম বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, প্রতিটি উপজেলায় আমাদের ফসলরক্ষা বাঁধের একজন জেলা থেকে দায়িত্বে রয়েছেন। শাল্লার দায়িত্বে আছেন স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক দেওয়ান মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। আপনি তার সাথে কথা বলুন।
স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে ফসলরক্ষা করা। সেটা পানি উন্নয়ন বোর্ডই হোক আর সওজই হোক। হাওরের ফসলকে অরক্ষিত রেখে কোন কাজ করা যাবে না। উন্নয়নকাজ করতে হবে হাওরকে সুরক্ষিত রেখে। ইউএনও’র সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান তিনি।
সড়ক ও জলপথ বিভাগ সুনামগঞ্জ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, হাওর এলাকায় ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ করতে হলে আমরা একটা টেকনিক্যাল স্টাডি করাই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ীই ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। আমরা ইচ্ছাকৃত কিছু করছি না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী ও উপজেলা কাবিটা স্কিম বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব (এসও) রিপন আলী বলেন, তারা যে এখানে ব্রিজ তৈরি করবে তা আমাদের জানায়নি। আমি ইউএনও’র যৌথ স্বাক্ষরে একটি চিঠি দিব ফসলরক্ষা বাঁধের যে প্রয়োজন আছে। কারণ ২৩ কোটির মধ্যে ১২ কোটিই বরাদ্দ দিয়েছি ছায়ার হাওরে। কাজেই ছায়ার হাওরকে অরক্ষিত রাখা যাবে না।
এ ব্যাপারে শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কাবিটা স্কিম বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি মনজুর আহসান বলেন, আমরা বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মহোদয়সহ দেখবো। পরে রোডস এন্ড হাইওয়েকে জানাব। এটা আজকেই করবো আমরা।
উল্লেখ্য, সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা ২০১৭ অনুযায়ী ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে উপজেলার ৬টি হাওরে ৮৪.২৮৩ কিঃমিঃ বাঁধ সংস্কার কাজ করা হবে। এতে পিআইসি (প্রকল্প) গঠন করা হয়েছে ১৩১টি। এরমধ্যে ক্লোজার রয়েছে ৩০টি। বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৩ কোটি টাকা। ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ সালে ফসলরক্ষা বাঁধ মেরামত কাজের শুরু হয়। কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২৮ ফেব্রুয়ারি।