1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
বুধবার, ০৭ মে ২০২৫, ০৩:০৬ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

স্ম র ণ : সীতেশ রঞ্জন আচার্য্য : স্বপ্নালু এক অধ্যাপক

  • আপডেট সময় সোমবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৩

ডা. চন্দ্রকান্তা আচার্য
১৯৩৭ সালের ২২ শে মার্চ, মাসের উষ্ণ একটি দিন। সুরমা নদীর শান্ত জল বয়ে চলেছে টলটল করে। নদীর পাড় ঘেঁষেই জয়নগর গ্রাম। পায়ে হাঁটা একটা পথ, পথের দুই ধারে সুপারি গাছের সারি। পথটি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে বেশ বড় একটা বাড়ি। বাড়িটির পেছন দিকে একটা পুকুর। সেই বাড়িটিতে আজ বড়ো আনন্দের একটি দিন। কিন্তু তা সত্ত্বেও গৃহকর্তা রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে বাজারের দিকে হাঁটা ধরেছেন, হাতে একটা ছাতা নিয়ে। কী ব্যপার?
না, এটা সত্যিকারের রাগ নয়। প্রচলিত নিয়ম নাকি আছে যে, তিনটি কন্যা সন্তানের পর প্রথম পুত্র সন্তানের জন্মের খবর শুনলে পিতাকে কপট রাগ দেখিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে হয়! তাই পুত্র সন্তানের জন্ম সংবাদ শোনা মাত্রই গৌরারং এমই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুরেশ চন্দ্র, আমার ঠাকুরদাদা, রাগ করে চললেন বাজারে।
সেই পুত্র সন্তান আগামী পনেরো বছর এই নিভৃত প্রকৃতির একান্ত প্রিয়তম সন্তান হয়ে শৈশব ও কৈশোর কাটাবে। এই পনেরটি বছর তার অজান্তেই পুরো জীবনের ভ্রমণের জন্য তাকে তৈরী করে দেবে। বলা বাহুল্য তিনি আমার বাবা সীতেশ রঞ্জন আচার্য্য।
আমার ঠাকুরদাদা সুরেশ চন্দ্র আচার্য ছিলেন ব্রিটিশ আমলের বি.এসসি পাস। শোনা যায় খবর পেয়ে গ্রাম গ্রামান্তর থেকে তাঁকে দেখতে এসেছিলো মানুষ। গৌরারং স্কুলে চাকুরীর সুবাদে সেখানের তৎকালীন গৌরারং জমিদার বাড়ির জমিদার নগেন চৌধুরীর সাথে অত্যন্ত হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠে উনার। সেই সূত্রেই নগেন চৌধুরী হাতিতে চড়ে সুরেশ চন্দ্রের বাসায় আসেন তাঁর আমন্ত্রণে! ঠাকুরদাদা অঙ্কে ছিলেন তুখোড়। তাঁর বড়ো ছেলেকে অঙ্ক-বিজ্ঞান পড়িয়ে ডাক্তার-টাক্তার কিছু একটা বানাবেন ভীষণ ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু কিছুদিন যাবার পরই বুঝতে পারলেন এই ছেলেটির অঙ্কের বইয়ের থেকে মহাভারতে বেশি আগ্রহ। সীতেশকে দেখা গেলো দিব্যি বই পড়া শিখে অল্প কিছুদিনের মাঝেই। সন্ধ্যে বেলা বাবু হয়ে বসে সে কাশীরাম দাসের মহাভারত পাঠ করছে। আর চারদিক থেকে লোক এসেছে তার সুরেলা গলায় মহাভারত পাঠ শুনতে। কোনো বৃদ্ধা কাকীমা হয়তো আবার আবদার করছেন – “ওরে সীতু ওই অর্জুনের মাছের চোখ বেঁধার জায়গাটা আরেকবার পড় দেখি!”
রাতে খেতে বসে সুরেশ চন্দ্র তাঁর সহধর্মীণি ষোড়শী বালাকে বললেন, “তোমার ছেলেটার তো দেখছি অঙ্কে একদম মন নেই?”
ষোড়শী বালা হবিগঞ্জের বানিয়াচং গ্রামের গৃহস্থ পরিবারের মেয়ে, ছেলেকে তিনি বুকের ভেতর আগলে রাখেন। সেই কবে পুতুলখেলার বয়সে তাঁর শ্বশুরমশাই তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি ভয় পেয়ে কাঁদছেন দেখে কোলেই উঠিয়ে নিয়েছিলেন তাঁকে শ্বশুরমশাই।
ষোড়শীবালাকে তার ছেলের অঙ্কে মতিগতির অভাব নিয়ে বিশেষ চিন্তিত মনে হলো না। বরং ঘোমটাটা আরেকটু টেনে বললেন – “আপনি ভাববেন না তো। আপনি দেখবেন অঙ্ক না পারার জন্য আমার ছেলের আটকাবে না!”
সুরেশ চন্দ্রের পরিবারে মানুষ তখন কম ছিলো না। তার একমাত্র বোন, ছেলেদের নিয়ে তাঁদের সাথেই থাকতেন। সবার চোখের মণি হয়ে বড়ো হতে থাকেন সীতেশ।
শীত পড়ে আসলে সুরমা নদীতে শুরু হয় মাছ ধরা উৎসব। চারদিক থেকে অসংখ্য বড় বড় নৌকায় ছেয়ে গেছে নদী। বিশাল জাল ফেলা হচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট মৌসুমে কয়েকদিন ধরে চলবে এই মাছ ধরা। নৌকো ভর্তি করে মাছ ধরবেন জেলেরা। একে বলা হতো নিম-বাইচ।
সীতেশ আবদার ধরলেন নিম বাইচ দেখতে যাবেন। অমনি পিসতুতো ভাই সোনাদাদা কাঁধে চড়িয়ে দেখাতে নিয়ে গেলেন নিমবাইচ। জীবনের শেষ পর্যন্ত সোনা দাদা, ধন দাদাদের মনে রেখেছিলেন তিনি।
বাবার আরেকজন অন্যতম সহচর ছিলেন তাঁর আরেক গোষ্ঠী ভাই, রাজকুমার আচার্য, যাকে কনা দাদা বলে ডাকতেন তিনি। কোথায় কোন গাছে পাখির ছানা ফুটেছে অথবা কোথায় নদীর পাড়ে কচ্ছপের ডিম পেড়েছে, সব দেখার একমাত্র সঙ্গী ছিলেন এই কনা দাদা।
পিতা সুরেশ চন্দ্র বাড়ি ফেরার সময় হাতে করে নিয়ে আসতেন দেশ বিদেশের নানান চমৎকার সব বই, গোয়েন্দা কাহিনী। সীতেশ গোগ্রাসে গিলতেন সব। ক্রমেই লক্ষ করা গেলো ছেলেটি পড়াশোনায় ভারী লক্ষ্মী। অসাধারণ তাঁর স্মৃতিশক্তি। বাংলা আর সংস্কৃতে কি দারুণ দক্ষ! আর ইতিহাস যেনো সে চোখের সামনে গল্পের মতো দেখতে পায়। সাহিত্যের মাঝে ডুব দিতে চায়। এভাবেই কাটছিলো দিন।
এর মধ্যে ছোট তিন ভাই ও আরো দুই বোনের জন্ম হয়েছে। সবাইকেই অসম্ভব ¯েœহে মুড়িয়ে রাখেন সীতেশ। তারপর সুনামগঞ্জ শহরে হাইস্কুলে পড়াশোনা করতে চলে এলেন তিনি। খুব সাফল্যের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করলেন। ১৯৫৪ সালে একটি লেটার পেয়েছিলেন। ঠাকুরদাদার মন অবশেষে শান্ত হলো।
উচ্চ মাধ্যমিকেও অসম্ভব ভালো করলেন, ততোদিনে চারদিক জেনে গেছে সীতেশ রঞ্জন নামে একটা
ছেলে উঠছে। তখনকার দিনে ¯œাতক সম্মান না থাকায় সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজে বিএ ভর্তি হলেন। যথারীতি স্ট্যান্ড করলেন। এরপর ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষায় বসলেন। দেখা গেলো প্রথম তিনজনের মধ্যে উনি একজন। শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়। ইংরেজি সাহিত্যের ভিতরে সেই যে ডুব দিলেন, তার থেকে আর বেরোন নি বাবা। নানান পত্রিকা বা সংখ্যায় বিখ্যাত সব ইংরেজি কবি কোলরিজ, টেনিসন, শেলীকে নিয়ে যেভাবে লিখতেন বাবা, এখন পড়লে মনে হয়, চাইলে আরো কতো বিস্তৃত হতে পারতো বাবার এই গবেষণা।
বাবার জীবনে ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রভাব অসামান্য। তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করতেন ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরীর মতো শিক্ষকরা। বাবা ড. জিসি দেবের অত্যন্ত ¯েœহধন্য ছিলেন। তখনই লাইব্রেরিতে বসে অসংখ্য অসংখ্য বই পত্রে ডুবে যাচ্ছিলেন।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স শেষ করেই সুনামগঞ্জ কলেজে প্রভাষক পদে জয়েন করেন। নিজের পিতার সমস্ত দেনা নিজের সম্মানী দিয়ে পরিশোধ করেন।
অধ্যাপনা জীবনের সবগুলো বছরই বাবা সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে অতিবাহিত করেন। তার জীবন স্মৃতিতে এই বৎসরগুলোকে জীবনের অন্যতম সেরা সময় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রিন্সিপাল ক্যাপ্টেন করিম উদ্দিন, মন্নান চৌধুরী উনাদের সাথে বাবার গভীর আত্মিক সম্পর্ক ছিল। বিভিন্ন সময়ে কলেজের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে বাবা সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন।
দার্শনিক জীবনে বাবা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী ঋষি শ্রী অরবিন্দের একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। মানব মন পরিণত হয়ে একসময় সুপার মাইন্ডে পরিণত হবে এই ধরনের চিন্তার মাঝে বাবা একধরনের মুক্তি খুঁজে পেলেন। একাগ্র চিত্তে সকলের মঙ্গল কামনা করলেন ও একান্তে বসে প্রত্যক্ষ করে গেলেন সবকিছু একজন দর্শকের মতো। নিজেকে রাখলেন এই পৃথিবীর কলুষতা থেকে একদমই বাইরে। তাতে হয়তো বাবা ভীষণ এক শান্তিময় পৃথিবীতে বাস করলেন কিন্তু পৃথিবীকে অনেক কিছু দেবার ছিলো যা আর দেয়া হয়ে উঠলো না। তাও জীবনের শেষ পর্যন্ত বাবা নির্মলতাকেই আকড়ে ধরেছিলেন।
বৈষ্ণবকবি রাধারমণ দত্তসহ সুনামগঞ্জের আরো মরমী কবিদের গান তিনি অপূর্ব ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। যা প্রকাশিত হয় ঝঁহধসমধহল রহ গুংঃরপ ঝড়হমং বইটিতে। সুনামগঞ্জের পত্রিকা সুনামকণ্ঠে উনার ছোটোদের জন্য রবিনহুডের গল্প, রূপকথার গল্প প্রকাশিত হয়েছে।
বাবা এইসবকিছুর মধ্য দিয়ে এক অদ্ভুত সরলতাকে ধরতে চেয়েছেন। বাবা জীবনের শেষ পর্যন্ত এটাই বিশ্বাস করে গেছেন একমাত্র ভালোবাসা আর বিশ্বাসই পারে জয় করতে সবকিছু।
তাই হয়তো যারা তাঁর কাছে আসতো কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে এই লোকটার অন্তর শিশুর মতো সহজ, সরল। তাইই বুঝি এক তরুণ কবি ও প্রভাষক কাওসার আলম বাবার সান্নিধ্যে এসে তাঁকে এক কবিতায় লিখেন-
“মুখমন্ডলে তাঁর প্রতিভার স্বর্গীয় বিভা
অন্তরে বহমান নদী নিস্তরঙ্গ নরম জলের।
যদি সাহস করে বলতে পারেন
একবার, ‘সীতেশদা, আপনাকে আজ
মানিয়েছে খাসা’
আর জানবেন
অর্ধেক হৃদয় তার নিয়েছেন
জয় করে অনায়াসে।
এমন সরল শিশু ক’জন বা হতে পারে
এ সংসারে?”
এই কবিতাটাতে বাবাকে কী সুন্দরভাবে ধরে রাখা হলো, তা ইনি ছাড়া কেউ পারতেন না। আমার অকুণ্ঠ ভালোবাসা কবির প্রতি।
এই ধরনের মানুষ বোধহয় সংসার করার জন্য পৃথিবীতে আসেন না। কিন্তু বাবা সংসার করেছেন, মাকে পাশে পেয়েছেন যোগ্য সহধর্মিণী রূপে। আমরা চার ভাইবোন নিজেদের মতো বড়ো হয়ে গেছি। আমাদের সবারই বাবার সাথে অসংখ্য চমৎকার সব স্মৃতি! রিটায়ারমেন্টের পরের সময়টা বাবা মূলত পড়াশোনা করেই কাটাতেন। বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্র, দেশ-বিদেশের ম্যাগাজিন, পাবলিক লাইব্রেরির বই। নিজের ডায়রিতে নোট করতেন সারাক্ষণ।
বাবা নিজেকে সুনামগঞ্জের মধ্যেই আবদ্ধ রেখেছেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস ২০১২ সালের ২৫ ডিসেম্বর অন্য ভুবনে যাত্রায় রওনা দেবার সময় বাবার ঝুলি খালি ছিলো না। সুনামগঞ্জের মানুষ বাবাকে যে অসম্ভব ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা দিয়েছেন তা সহজে দেখা যায় না।
আজ বাবার মৃত্যুর ১১ বছর পূর্ণ হলো। সেই উপলক্ষে এই স্মৃতিচারণে সবার সাথে আমি বাবাকে স্মরণ করতে পেরে আনন্দিত।

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com