“আমি তো রাজনীতি করতাম না। কোন দলের মিটিং মিছিলে যেতাম না। তারপরও কেন তারা আমার গায়ে আগুন দিল?’ মৃত্যু শয্যায় পড়ে থেকে যিনি এই প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি আর জীবিত নেই। তার নাম বেলাল, ট্রাকের হেলপার। গত রবিবার (৪ ডিসেম্বর ২০২৩) চালভর্তি ট্রাক নিয়ে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা থানার তাইন্দং সরকারি খাদ্যগুদামে যাওয়ার পথে হাফছড়ি এলাকায় ট্রাক থামিয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়ে ট্রাক পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে ট্রাকের ড্রাইভার ও হেলপারের গায়েও আগুন দেওয়া হয়।
আন্দোলকরা নির্বাচনে অংশ নেবেন না, ভালো কথা। অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের প্রতিবাদ করবেন, আরও ভালো কথা। অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করবেন, তাদের সঙ্গে আমরাও আছি। গণতান্ত্রিক অধিকার আমাদেরও দরকার। কিন্তু মানুষের জন্য অধিকার আদায় করতে গিয়ে মানুষকেই হত্যা করা কেন? বিদগ্ধমহলের মনে এমন প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনবিরোধী আন্দোলকরা ইচ্ছে করলে ট্রাক পুড়িয়ে ক্ষান্ত হতে পারতেন, কিন্তু তা তারা করেন নি। বলতেই হয়, ইচ্ছা করেই করেন নি। তারা ভেবেছেন ট্রাক পুড়ালে সন্ত্রাসের ভয়াবহতা বাড়বে না, সন্ত্রাসের বাহাদুরি দেখিয়ে সরকারের পতন নিশ্চিত করতে হবে। তাই ট্রাক পুড়ানোর সঙ্গে দুয়েকজন মানুষ না পুড়ালে সন্ত্রাসের ষোলকলা পূর্ণ হবে না। কিন্তু জেনে রাখা ভালো যে, সন্ত্রাসের ষোলকলা পূর্ণ করে গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তারা সেটা বোঝেন না। কিন্তু তাদেরকে সেটা বোঝতে হবে, আজ না হয় কাল।
সন্ত্রাস করে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন্ হয়ে গেলে রাজনীতি হয় না, হলেও সেটা হয় আত্মস্বার্থ উদ্ধারের রাজনীতি, স্বৈরতান্ত্রিকতার কাছে একধরণের আত্মসমর্পণ। দেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আত্মস্বার্থই স্বৈরতান্ত্রিকতার জনক। ইউক্রেনে যুদ্ধ বাঁধিয়ে, মানুষ মারতে মারতে অস্ত্র বিক্রির সুযোগ তৈরি করতে বিশ^পরিসরে পুঁজিপতিরা তৎপর, তা না হলে পুঁজিবাদের ভেতরে লাগা বিশ্বমন্দার বিপদ উতরানো যাচ্ছে না। বিশ্বপুঁজিপতির দল এখন বিশ^বাজারটিকে পুনর্বণ্টন করতে চাইছে। বিশ্বযুদ্ধ লাগে তো লাগুক, যুদ্ধই কেবল পুঁজিপতির তহবিলে পুঁজির পুঞ্জিভবনকে সম্ভব করে তোলবে, পুঁজিবাদের আয়ু বাড়বে, পুঁজিপতিরা পৃথিবীর শ্রমিক-কৃষককে আরও কীছু দিন শোষণ করার সুযোগ পাবে।
বাংলাদেশে যুদ্ধ নয় বটে, তবে নির্বাচনকে উপলক্ষ্য করে বাজার দখলেরই তৎপরতা চলছে, সেটা যুদ্ধে রূপান্তরিত হলেও হতে পারে, সে-সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিদগ্ধমহলের ধারণা, যুদ্ধবাজদের যুদ্ধ লাগানোর কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিএনপি-জামায়াতের যৌথ তৎপরতায় এখানে সন্ত্রাসী আন্দোলনের সূত্রপাত। প্রকৃতপ্রস্তাবে সন্ত্রাসী হয়ে উঠার স্বার্থটা দেশ শাসনের একচেটিয়া ক্ষমতা অর্জন ভিন্ন অন্য কীছু নয়, যাতে করে নিজেরা টাকার কুমির হওয়া যায়, সহজে গড়া যায় টাকার পাহাড় এবং যথারীতি সাম্রাজ্যবাদীও দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের সুযোগ পায়। এই করতে গিয়ে তাঁরা যে-মানুষের জন্য সাচ্চা গণতন্ত্র চান, সে মানুষকেই হত্যা করছেন নির্দ্বিধায়।
তাই প্রশ্ন, তাঁরা আসলে কার গণতন্ত্র চান? দেশের মানুষকে মেরে, তাঁদের শোষণ করার নিশ্চিত ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করার সুয়োগ তৈরি করাই কি বর্তমানের সন্ত্রাসী আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য? কিন্তু আমরা বলি, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পরিস্থিতিকে হৃদয়ঙ্গম করুন এবং সন্ত্রাসের পথ পরিহার করুন।