‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধকল্পে আলোচনা সভা’ গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি শিরোনাম। শিরোনামটির ভাবভঙ্গিমা এমন যে, পাঠসমাপ্তির পর কোনও কোনও পাঠকের মনে মাদকদ্রব্যের নির্দোষ ও সুব্যবহারের একটি ধারণা উদ্রেক হতে পারে। অর্থাৎ সমাজে মাদকদ্রব্যর সুব্যবহার আছে এবং তা রোধ করার কোনও প্রয়োজন নেই। এমন হতে পারে না। সমাজকে সুস্থতার দিকে ফেরাতে হলে মাদকের ব্যবহার রোধ নয়, পুরোপুরি বন্ধ করাই কর্তব্য। তার জন্য কী করতে হবে? ভিন্নজনের থেকে এর ভিন্ন ভিন্ন উত্তর পাওয়া যেতে পারে এবং তাই স্বাভাবিক। কেউ বলতেই পারেন যে, সমাজের সকলে মাদকগ্রহণ থেকে বিরত থাকলেই হলো। সমাজের কেউই যদি ব্যবহার না করেন, অর্থাৎ চাহিদা যদি না থাকে, তাহলে যোগান থাকবে না, অর্থাৎ মাদকের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। এই বাস্তবতার বিপরীতে মুনাফা অর্জনে যাচ্ছেতাই করতে প্রস্তুত ব্যবসায়ীরা বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে সমাজে মাদকের চাহিদা তৈরি করবে। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের সমাজটা এমনই যে, এখানে সহজে মাদকের চাহিদা তৈরি করা যায়। তেকারণে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মাদকবিরোধী শত প্রচারের পরেও মাদকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে বই কমছে না। সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লিখে দেওয়া হচ্ছে যে, সিগারেট পানে ক্যান্সার হয়, সিগারেট পান মৃত্যুর কারণ, কিন্তু এবংবিধ প্রচারের কারণে সিগারেট উৎপাদন বন্ধ করা হচ্ছে না, বরং এখানে মানুষের নেশার দুর্বলতাকে মুনাফা আর্জনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক পণ্য কেন উৎপাদন করার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন থাকবে, সেটা কীছুতেই বোধগম্য নয়। রাষ্ট্র কেন তা বন্ধ করে দিচ্ছে না? সুতরাং মাদক রোধের আন্দোলন থেকে মাদক বন্ধের আন্দোলনে নামতে হবে। মাদককে রোধ করা নয় বন্ধ করে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের মতো আইন প্রণয়নে ও আইন প্রয়োগে শৈথিল্যপ্রকাশপ্রবণ দেশে নেশাজাতীয় পণ্যের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া সত্যিতার অর্থেই একটি মুশকিলের ব্যাপার। কারণ মাদকের ব্যবসায় বন্ধ করার একমাত্র প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র, আর এই রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকাংশ প্রতিনিধিরাই মুনাফানির্ভর অর্থনীতির সমর্থক। মাদকবাণিজ্যও মুনাফানির্ভর, সুতরাং বন্ধ হয়ে যাওয়ার তার কোনও ভয় নেই। এই সহানুভূতিশীলতা থেকেই মাদককে না বলার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়েছে, মাদককে বন্ধ করার ঘোষণা করা হচ্ছে না।
জানা কথা, সাধারণ মানুষ যতই মাদকের বিরুদ্ধে দাঁড়াক না কেন, তাদের মধ্য থেকে একটি অংশ বিভিন্ন সামাজিক কারণে মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠবেই। এই আসক্তিই সমাজে মাদকের চাহিদা গড়ে তোলবে এবং মাদকের ব্যবসায়কে বহাল ও চাঙ্গা রাখবে। আসলে মাদককে রোধ থেকে বন্ধের প্রত্যয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো মুনাফা। কারণ মুনাফাখোর মানুষের তরফে মানুষের মৃত্যুর তোয়াক্কা করার কোনও নীতিবোধ নেই, তার কোনও কীছুতেই কোনও নৈতিকতা নেই। মুনাফাখোর মানুষ মানুষের মৃত্যু নিয়েও ব্যবসা করে। তাই দেশে দেশে যুদ্ধ চলে, বিশ্বযুদ্ধ হয়। মুনাফারনির্ভর রাষ্ট্রীয়নীতি যত দিন কর্মপ্রয়োগের ক্ষেত্র দখল করে থাকবে তত দিন পর্যন্ত প্রতিরোধ আন্দোলন চলবে এবং মাদকের ব্যবসায়ও বন্ধ হবে না। মাদক উৎপাদনের ও ভিন-দেশ থেকে দেশে প্রবেশের অনুকূল প্রেক্ষিত সৃষ্টি করে মাদককে রোধ করার কর্মসূচি পালনের নির্গলিতার্থ একটাই, আর সেটা হলো, মাদক ব্যবসায় চলছে এবং চলবেই। সব কথার শেষ কথা হলো এর একটাই সমাধান, চোখ বোজে দেশে মাদক তৈরি ও অনুপ্রবেশ বন্ধ করে দিতে হবে, এর কোনও বিকল্প নেই।