পত্রিকায় প্রকাশ একযুগ ধরে বিশ্বম্ভরপুরের প্রথম শহীদ মিনার কোনও এক ব্যক্তি বিশেষ দখল করে রেখেছেন। দখলের স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে দৈনিক সুনামকণ্ঠের প্রতিবেদক লিখেনÑ ‘সরেজমিন দেখা গেছে মাত্র ১৩৫ বর্গফুট (কোয়ার্টার শতাংশ) জায়গা টিন দিয়ে ঘেরাও করে পুরনো শহীদ মিনারটিকে ধরে রাখা হয়েছে। এর চারদিকে শহীদ মিনারের সম্পূর্ণ জায়গায় পাকা ঘরবাড়ি ও দোকানকোঠা নির্মাণ করা হয়েছে।’
শহীদ মিনারের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের সংস্কৃতি থেকে যে কোন জনগোষ্ঠী স্বীয় জাতিগত মহত্ব ও গৌরবকে বিশ্বসভায় সমুজ্জ্বল করে তোলে রাষ্ট্রিক সার্বভৌম অস্তিত্বকে ঘোষণা করে। জাতিগত সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোর ভেতরে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে যাঁরা অকাতরে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন তাঁরাই জাতির প্রতিটি ব্যক্তি বিশেষের কাছে সর্বাগ্রে নমস্য ও শ্রদ্ধালাভের পাত্র। তাই তাঁদের স্মৃতির স্মারক শহীদ মিনারের প্রতি যদি যৎসামান্য অবহেলা, অবজ্ঞার আভাসমাত্র পরিলক্ষিত হয় জনগোষ্ঠীর কোন শ্রেণি-স্তর বা ব্যক্তি বিশেষের আচরণে ও মানসতায়, তবে ধরে নিতে হবে ওই শ্রেণি বা ব্যক্তি এই জাতির কেউ নয়। শহীদ মিনারকে অবজ্ঞাকারী যে কেউ, নির্দ্বিধায় বলা যায়, সংশ্লিষ্ট জাতি থেকে ভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন অংশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বপরিসরে একটি বিরল ও ব্যতিক্রমী ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র গঠনে শহীদদের অবদান বলতে গেলে প্রায় সবটুকুই। তাঁদের রক্তের রূপকল্পের অন্যনাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এই রাষ্ট্রের ভিতরে শহীদ মিনারের নির্মিতি এমন একটি সাংস্কৃতিক উপাদান, যে উপাদানকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে কল্পনা করা যায় না। আর যে ব্যক্তি বা শ্রেণি এই শহীদ মিনারকে নিজের কোনও আচরণের দ্বারা অবজ্ঞা-অবহেলা প্রদর্শনের সাহস করবে, প্রকৃতপক্ষে সে বা তারা নিজেকে জাতিসত্ত্বা থেকে স্বপ্রণোদিত হয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে, আর প্রকারান্তরে নিজেকে ভিন্ন করে ফেলবে জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে। অর্থাৎ শহীদ মিনারকে অবমাননাকারীরা অস্বীকার করবে স্বীয় নাগরিকত্বকে। নীতিগত বিবেচনায় শহীদ মিনারের জায়গাদখলকারী কোনও মানুষ এদেশের নাগরিক হওয়ার অধিকার রাখে না। তাই এদেশের নাগরিক বিবেচনা করে তার রেকর্ডীয় সম্পত্তিতে তার ব্যক্তিগত অধিকারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ারও কোনও যৌক্তিকতা নেই। বিষয়টি রাষ্ট্রপরিচালনায় অধিষ্ঠিতদের ও বিচার বিভাগের বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ সিদ্ধান্তে আসা উচিত অচিরেই এবং সে অনুসারে আইন প্রণয়ন আবশ্যক অর্থাৎ অবশ্য পালনীয় একটি রাষ্ট্রীয় কর্তব্য। অন্যথায় যত্রতত্র শহীদ মিনারগুলো সম্পত্তিলোভী মানুষের জবরদখলী সম্পত্তিতে পরিণত হবে। শহীদ মিনারকে নিয়ে এইরূপ তৎপরতা চলতে দেওয়া আর জাতির ললাটে কলঙ্কের তিলক পরিধান করার অপকর্মে লিপ্ত হওয়া সমার্থক।
সুনামগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটির অবস্থা প্রায় বিশ্বম্ভরপুরের প্রথম শহীদ মিনারটির মতোই। ইতোমধ্যে এই শহীদ মিনারটিকে স্থানান্তরকরণের প্রস্তাব উঠেছে, যাতে শহীদ মিনারের পরিত্যক্ত স্থানটিকে বাণিজ্যিকভিত্তিতে ব্যবহার করা যায় অর্থাৎ সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভরপুরের শহীদ মিনারের সঙ্গে একই আচরণ করা হচ্ছে, সার্বিক বিচারে যা অসঙ্গত। আমাদের জাতিগত পরিচয়ের প্রতীক ও গৌরবের এইসব মিনারগুলোকে সুরক্ষা ও সংস্কার করার পদক্ষেপ গ্রহণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে অবিকল্প জাতিগত কর্তব্যে পর্যবসিত হয়েছে। আমরা জেলা প্রশাসনসহ, সকল সামাজিক সংগঠনের প্রতি, যেখানে যেখানে শহীদ মিনার আছে সেখানকার সে সব স্থাপনা রক্ষা ও সংস্কারের কাজে সচেতন ও সক্রিয় হতে এবং জনগণকে নিয়ে শহীদ মিনার সংরক্ষণ আন্দোলন গড়ে তোলতে আহ্বান জানাচ্ছি।