গত সোমবারের (১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩) দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদশিরোনাম ছিল, ‘এবার হাওরের নাম বিকৃত করে পাউবো’র সাইনবোর্ড’। সংবাদবিবরণীতে লেখা হয়েছে, “সম্প্রতি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ অফিসের উদ্যোগে এই হাওরপাড়ের বিভিন্ন স্থানে ‘ডেকার হাওর’ নাম উল্লেখ করে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। বিষয়টি নজরে পড়ায় হাওরপাড়ের বাসিন্দারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। হাওরের নাম বিকৃত করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। এর আগে, সম্প্রতি তাহিরপুর উপজেলার ‘বৌলাই নদী’র নাম বিকৃত করে ‘বাউলাই নদী’ লিখে তাহিরপুর থানার সামনে পানি উন্নয়ন বোর্ড সাইনবোর্ড টাঙায়। এছাড়াও তাহিরপুরে পাটলাই নদীর নাম বিকৃত করে ‘পাটনাই’ লিখে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাইনবোর্ডে দেখার হাওরের নাম সঠিকভাবে লেখার দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করা হয়েছে। গত রবিবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেন ছাতক উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অলিউর রহমান চৌধুরী বকুল।”
আমরা জনাব অলিউর রহমান বকুলকে এবং সেই সঙ্গে এলাকাবাসীকেও বলছি, আপনারা যতই আবেদন- নিবেদন করুন না কেনও কীচ্ছুটি হবে না। আপনারা ভুলে যাবেন না যে, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’। আর প্রবাদ তো বলেই দিয়েছে, ‘কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না, স্বভাব যায় না মইলে’। সুতরাং পাউবো এসব তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেই। জানবেন আপনার নাম আব্দুল হলে পাউবো আব্দুল্যা করার অধিকার রাখে!
আসল বিষয় হলো, পাউবোর প্রতিটি কর্মকর্তা প্রকৃতপ্রস্তাবেই ‘মেকলেচেলা’, যে মেকলের পুরোনাম টমাস বেবিংটন মেকলে (১৮০০Ñ১৮৫৯)। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের চতুর্থ দশকে ভারতবাসীকে ইংরেজিতে শিক্ষাগ্রহণের সরকারি নীতি কার্যকর করার প্রস্তাবনা করে বলেছিলেন যে, ভারতবাসীকে মনে-মগজে ইংরেজ হতে হবে। অর্থাৎ তারা খালে-চামড়ায় যতই ভারতীয় হোক তারা চিন্তা করবে ইংরেজিতে, ভারতের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে কাজ করবে ইংরেজদের মতো, ভারতকে শাসন করবে ইংরেজদের হয়ে ইংরেজদের স্বার্থরক্ষার্থে, ভারতের সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করার স্বার্থে।
পাউবোর শিক্ষিতরা এই মেকলের যোগ্য উত্তরসূরি। তারা এখনও তাদের নমস্য গুরু ইংরেজ মেকলের ভাবাদর্শকে সম্মান করে চলেন, চিন্তা করেন ইংরেজিতে তারপর আনুবাদ করেন বাংলায়। তাই দেখার হাওর, বৌলাই ও পাটলাই হয়ে পড়ে যথাক্রমে ডেকার হাওর, বাউলাই, পাটনাই এবং এতো দিন পরে, সেই ১৮৩৮-এর পরে থেকে এখনও পর্যন্ত সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানেও ‘বাবা মেকলে’র পরম্পরা তাঁরা বজায় রেখেছেন পরম শ্রদ্ধায়। একেই বলে স্বভাব যায় না মইলে। তারা স্বভাব ছাড়েনি। সুতরাং আপনার নাম যদি মুহাম্মদ হয় তবে পাউবো যদি লিখে দেয় ‘মহামমেড’ সেটাই সই, আপনাকে মেনে নিতেই হবে কিংবা আপনার নাম হতে পারে ‘দিদার’, সেক্ষেত্রে পাউবো ‘ডিডার’ লিখে দেবার অধিকার রাখে। বাংলাদেশের মেকলেতান্ত্রিক আমলাতন্ত্রের পক্ষে এসব কীচ্ছু না, ডালভাত মাত্র।
আইনের দৃষ্টিতে নাম বিকৃতকরণ অপরাধ কিনা জানি না, তবে নাম সামান্য একটু বিকৃত হলে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সে নামকে স্বীকার করা হয় না, তার প্রচুর প্রমাণ আছে। এটা একটি সর্বজন স্বীকৃত সত্য। এই অপকর্মটি কোনও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান করবে কেন, আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা বিকৃত নাম সাইনবোর্ডে লিখার নিন্দা করছি ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এর প্রতিকার কী হতে পারে, তার উত্তর আমাদের কাছে আছে কিন্তু তা ছাপার অযোগ্য বলে বলছি না। যে-কেউ সেটা কল্পনা করে নিতে পারেন।