দেশে অতীতে দুর্নীতি ছিল বর্তমানেও আছে এবং বর্তমানে দুর্নীতির আকার-প্রকার কিংবা ব্যাপকতা-গভীরতা বেড়ে গিয়ে সম্পদসৃষ্টির কারিগর তথা মেহনতি মানুষের উপর শোষণনির্যাতনের মাত্রা বহুমাত্রিক করে তুলেছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত সমাজসংস্থিতির এই রূপকে ভিন্ন ভিন্নজন ভিন্নভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন। তাঁদের এই ব্যাখ্যার ভেতরে একটা মিল পরিলক্ষিত হয়। তাঁরা প্রত্যেকেই সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানাসঞ্জাত শ্রেণিভিত্তিক সমাজের আদি বৈশিষ্ট্যÑ মানুষ কর্তৃক মানুষ শোষণের অন্যায়-অত্যাচারকে অকপটে স্বীকার করে থাকেন। যেমন আমাদের প্রিয় পরিকল্পনামন্ত্রীর বরাত দিয়ে গত রবিবারের (১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩) দৈনিক সুনামকণ্ঠে বলা হয়েছে, “দেশে দুর্নীতি বেড়েছে সন্দেহ নেই। উচ্চবিত্ত পর্যায়ে দুর্নীতি বেশি হচ্ছে। দুর্নীতিবাজরা ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, দুবাইসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অর্থপাচার করছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। এছাড়া ব্যাংকিং খাতেও প্রভাবশালীরা অর্থ লুটপাটের ঘটনায় জড়িত। দুই একজনকে গ্রেফতার করে জেলে নেওয়া হলেও টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত অনেককে আইনের আওতায় আনা উচিত।”
মন্ত্রীর এই মন্তব্যের ভেতরে নিহিত সত্যের প্রতিধ্বনি শোনা যায় যখন কেউ কেউ এই ‘প্রভাবশালীদের অর্থলুটপাটের ঘটনা’কে (অর্থাৎ শোষণের রূপবৈশিষ্ট্যকে) কাঠামোগত সহিংসতা বলে বর্ণনা করতে দ্বিধা করেন না এবং তদুপরি তাঁরা মনে করছেন যে, দুর্নীতির প্রসার দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশে প্রলম্বিত হয়ে বৈশ্বিকতার অন্যরকম মাত্রা অর্জন করে অতীতের চেয়ে বহুগুণ শক্তিসঞ্চয় করেছে। এই শক্তির প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয় ইতিহাস নির্দিষ্ট সমাজ বদলের নিয়মের (যেমন সামন্তবাদী সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজে কিংবা পুঁজিবাদী সমাজ থেকে সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণ) অনিবার্য সমাজবাস্তবতা বিপ্লব সংঘটনের সাংগঠনিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল ও প্রতিরোধ করার সা¤্রাজ্যবাদী প্রচেষ্টা বিশ্ব পরিসরে বর্তমানে প্রচ-ভাবে কার্যকর আছে ও বেশি বেশি করে শানিয়ে তুলতে চেষ্টার ত্রুটি করছে না। প্রকারান্তরে বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার সমাজসংস্থিতিক অনুঘটকগুলোকে দুর্বল ও প্রচ্ছন্ন করে দিয়ে বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার শক্তিকে ক্ষীণ করে দেওয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যদিও পুঁজিবাদ তার ক্ষয়িষ্ণুতাকেও প্রতিরোধ করতে পারছে না এবং তার ইতিহাস নির্দিষ্ট অনিবার্য মৃত্যু ক্রমে এগিয়ে আসছে, অর্থাৎ সমাজ বদলে যাবার সময় এগিয়ে আসছে।
দুর্নীতি বাড়ছে একথা সত্যি, সকলেই স্বীকার করেন, যেমন স্বীকার করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এবং তাঁর মতো অন্য কেউ কেউ। কিন্তু ‘কে এই দুর্নীতি করে?’ এই প্রশ্নের উত্তরে তার দায়টা ছড়িয়ে দেওয়া হয় দেশের সকল শ্রেণির ঘাড়ে, কেউই সাহস করে অন্তত গণমাধ্যমে স্বীকার করেন না যে, এই দুর্নীতিটা বেশি করে ধনীরা। সকল কথার এই সার কথাটা বলেছেন, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তাঁকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। সংবাদপ্রতিবেদনের শিরোনামে বিবৃত ‘দেশে দুর্নীতি বেড়েছে, বেশি করছে উচ্চবিত্তরা’ এই কথাটা জাতির মনে ও মননে জাগিয়ে তোলা আপাতত অত্যন্ত জরুরি জাতীয় কর্তব্য।