গত শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩) দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি শিরোনাম ছিল, “আমেরিকা প্রবাসীর অর্থায়নে সেলাই মেশিন বিতরণ”। অতিসংক্ষিপ্ত সংবাদবিবরণীতে লেখা হয়েছে, “সুনামগঞ্জ পৌরসভার অসচ্ছল নারীদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে আমেরিকা প্রবাসী মাসুদ আহমদের অর্থায়নে সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। বৃহ¯পতিবার সকাল সাড়ে ১১টায় সুনামগঞ্জ পৌরসভার হলরুমে নারীদের হাতে সেলাই মেশিন তুলে দেন মেয়র নাদের বখত।”
এই সংবাদবিবরণী যে-সংবাদ বিলি করছে সেটা আমরা অনেককাল আগে থেকেই পেয়ে আসছি এবং কর্ণান্তরের বিবাদভঞ্জন করে পরিতৃপ্তি লাভ করছি। ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে। সমাজে ব্যক্তিমালিকানা স্বীকৃতির কল্যাণে কোনও একজন এতো সম্পদের অধিকারী হন যে, তিনি হয় তা অপচয় করেন, নচেৎ দান করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। বর্তমান ভারতের এক ধনীলোকের বউ বিশেষভাবে বানানো কোটি টাকামূল্যের আইসক্রিম খান এবং একদা স¤্রাট শাহজাহান জগতকে বউয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা দেখাতে তাজমহল গড়ে তোলেন ক্ষুধার্থ কোটি প্রজাকৃষকের কাছ থেকে উচ্চহারে রাজস্ব আদায় করে এবং বিপরীতে একজন মহসিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে প্রকারান্তরে সাধারণ মানুষকে দান করে দেন সঞ্চিত সকল সম্পদ।
ব্যক্তিমালিকানা বিশিষ্ট সমাজের এমনটা একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, যাকে বলে বাদশা-ভিক্ষুকের সমাজ। এই বাদশা-ভিক্ষুকের এই প্রতিষ্ঠিত সমাজটিকে ভেঙে দিতে হবেÑ বদলে দিতে হবে। তা না হলে সুদূর আমেরিকা, বিলাত, কানাডা বা দুবাই থেকে এসে দেশের সম্পদহারা মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে সেলাই মেশিন বিতরণের মহড়া দিতে হবে বার বার। বাঙালিকে এই অশুভচক্রের নাগপাশ ছিন্ন করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, বাঙালির জাতীয় কবি বলেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’
কোটি লোকে ভাত-পায়-না-সমাজে একজন আইসক্রিম খাবে কোটি টাকা খরচ করে, এই বৈষম্য চলতে পারে না। সমাজের অন্য সকলকে শোষণ করে নিয়েই সঞ্চিত সম্পদ দিয়ে কোটি টাকার আইসক্রিম খাওয়া কিংবা কোটি টাকার পরিচ্ছদ-অলঙ্কার পরা, বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি করা অমানবিকতা ভিন্ন অন্য কীছু নয়। এটা বুঝতে হবে। পুঁজিবাদের স্বাভাবিক প্রকরণে ধনী হয়ে এই ধনকে মানুষ নিপীড়নের অস্ত্র করে তোলার প্রবণতা থেকে সরে এসে মানুষ হিসেবে মনুষ্যত্বের পরিচয় প্রদান করার প্রয়াসে নিমগ্ন হয়ে দানবীর মহসিন হওয়াই মুনষ্যত্বের উত্তম লক্ষণ। এমনবিধ চর্চা আমাদেরকে বজায় রাখতে হবে যতো দিন পর্যন্ত না সমাজ থেকে ধনবৈষম্যের বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে না পারা যায়। আজ যাঁরা ‘অসচ্ছল নারীদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে’ সেলাই মেশিন দান করেছেন, আমরা এই জনহিতৈষী কাজের জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানাই, তাঁরা আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন।