দেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে যে-সব কেলেঙ্কারি চলছে সে-সবের ফিরিস্তি এখানে উপস্থিত কারার কোনও অবকাশ আপাতত নেই। কিন্তু অবস্থা যে সত্যিকার অর্থে দুর্বিষহ তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। গণমাধ্যমে মাঝেমাঝেই তার বিবরণ পাঠ করা যায়। এমন পরিপ্রেক্ষিতে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে, কেউ বলতেই পারেন। আর কেউ যদি এমন বলেই ফেলেন, তাহলে বোধ করি, তাঁকে খুব একটা দোষ দেওয়াও যাবে না। কারণ আমাদের দেশের চিকিৎসাসেবাকে ইতোমধ্যে দামি পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। যেমন প্রসূতির পেটকেটে সন্তান বের করার মূল্য ৩০/৪০ হাজার টাকারও উপরে। তাছাড়া বেশ কীছু দিন আগে জীবনরক্ষাকারী অতীব প্রয়োজনীয় ঔষধের প্রতিটির দামই বাড়ানো হয়েছে আরেক দফা, উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। কীছু দিন পরপর এমন করে প্রায় বাড়ানো হয়। অর্থাৎ প্রকারান্তরে চিকিৎসাব্যয় দিন দিন কেবল বেড়েই চলেছে এবং প্রকারান্তরে সাধারণ মানুষ চিকিৎসাসেবার সুবিধা থেকে আনুপাতিক হারে বঞ্চিত হচ্ছেন, অব্যাহত গতিতে। একাত্তরোত্তরকালে প্রণীত সংবিধানে জাতীয় চারনীতির একটি ছিল সমাজতন্ত্র। আর এই সমাজতন্ত্রের আদর্শানুসারে তখন থেকেই চিকিৎসাসেবা বিনামূল্যে দেওয়ার নীতি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। অথচ বিগত অর্ধশতাব্দীকাল ধরে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদানের স্থলে স্বল্পমূল্যও নয় বরং উচ্চমূল্যে অর্থাৎ গলাকাটা দামে চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, চিকিৎসাকে করে তোলা হয়েছে দামি পণ্য, বিনামূল্যে তো দিল্লি দূরস্থ।
গত মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩) দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদপ্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সুনামগঞ্জ পৌরসভায় বিনামূল্যে জনগণকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য নিজস্ব অর্থায়নে একটি স্থায়ী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র চালু হয়েছে। সোমবার বেলা ১১টায় এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। পৌর কার্যালয় প্রাঙ্গণে আলাদা একটি অত্যাধুনিক ভবনে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামসহ এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এখানে নিয়মিত একজন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেবা ও বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেবেন।”
সাধারণ মানুষজন এই সংবাদে একটু হলেও আশ্বস্ত হয়েছেন, যদিও ব্যবস্থাটি প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য আয়োজন মাত্র। কিন্তু পৌরকর্তৃপক্ষের এই মহতি প্রয়াসটি বিনামূল্যে ‘চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি দিল্লি দূরস্থ’ ধারণাকে নাকচ করে দিয়েছে, ব্যাপকাকারে না হোক সীমিত ও স্বল্প মাত্রায় হলেও এবং অন্তত প্রমাণ করেছে বিনামূল্যে জনগণকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া যায়।
এই সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থাটি আসলে সামন্য নয়, এরমধ্যে মানবিকতার মহত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ কারণে সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখতকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। পাশাপাশি ধন্যবাদ জানাই পৌর কাউন্সিলর, পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে।
আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ পুঁজিবাদের অধীনে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত আছে এবং এর বিপরীতে পৌরসভার অপ্রতুল আয়োজনটি তথাকথিত সামজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদানের একটুকুনি নমুনা হাজির করেছে সাধারণ মানুষের খেদমতে। পৌরসভার এই চিকিৎসাপ্রয়াস, জানি না, পুঁজিবাদের শোষণভিত্তিক নীতির অধীনে বিশেষ করে চিকিৎসাকে উচ্চমূল্যের পণ্যে পরিণত করার দুরভিসন্ধিমূলক পদ্ধতিকে জনসাধারণরে পক্ষে বুঝে উঠতে পারার ব্যাপারে সহায়ক হয়ে উঠবে কি না, এমনটা হলেই মঙ্গল।