গ্রামের শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষাবাজেট বাড়াতে হবে
ইতিহাস বলছে, একদা ধনে-ধান্যে-পুষ্পে ভরা ছিল আমাদের এই প্রিয় দেশ। সম্পদের লোভে এলো লুটেরা বর্গীরা, এলো ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা। আরও কতো দেশি-বিদেশি লুটেরা শক্তির উন্মেষ হলো এখানে, আর এই লুটেরাশক্তির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলাল পঞ্চমবাহিনীর মতো দেশীয় দালালরা। ঔপনিবেশিকতার জালে বন্দি করে সমৃদ্ধ দেশকে নিঃস্ব করে দিলÑ সে বিস্তৃত ইতিহাসে যাচ্ছি না। অদূর অতীতের একসময় দেখা গেলো এই দেশে আর অভাবের কোনও অন্ত নেই, চিরন্তন এক অসীমতা নিয়ে অভাব এখানে সদাসর্বদা বিরাজিত। চারদিকে কেবল অভাব আর অভাব, কেউ কেউ দার্র্শনিকের মতো বলেন, কোথাও কোনও ভাবের দেখা মেলে না। যেমন গত বুধবারে (৩০ আগস্ট ২০২৩) দৈনিক সুনামকণ্ঠ “বিদ্যালয়ের অভাবে শিক্ষাবঞ্চিত শিশুরা” শীর্ষক শিরোনামে একটি সংবাদপ্রতিবেদন মুদ্রিত করে জানান দিচ্ছে এই দেশে শিক্ষার অভাব আছে। শিরোনামের নিচে লেখা হয়েছে, “গ্রামগুলোর চারপাশ টাঙ্গুয়াসহ বিভিন্ন হাওরবেষ্টিত। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হাওরপাড়ের বিনোদপুর, পনিয়াখালি, কান্দাপাড়া, রতনপুর গ্রামে নেই প্রাথমিক বিদ্যালয়। বর্ষায় নৌকা আর হেমন্তকালে হেঁটে যেতে হচ্ছে চার কিলোমিটার দূরবর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাড়ি থেকে স্কুল দূরে থাকায় শিশুরাও স্কুলে যেতে চায় না। ফলে শিক্ষাজীবনের শুরুতেই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ওইসব গ্রামের কোমলমতি তিন শতাধিক শিশু।”
২০২৩ সালে দেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে তখন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের এই পশ্চাদপদ অবস্থাটা প্রকৃতপ্রস্তাবে সম্প্রচারিত উন্নয়নকে পরিহাস করছে এবং সচেতন যে-কোনও মানুষকেই ভাবিয়ে তোলছে। কেবল টাঙ্গুয়ার পাড়ে নয়, খোঁজ নিলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অবস্থা অর্থাৎ অগণিত শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের সন্ধান পাওয়া যাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। শিক্ষাবঞ্চিত এই শিশুরা অদূর ভবিষ্যতে দেশকে ‘কন্যা দায়গ্রস্ত দরিদ্র পিতা’র মতো বিপদাপন্ন করে তোলবে, আর আধুনিক বৈদ্যুতিন প্রযুক্তি নির্ভর পৃথিবীতে তারা অপাঙক্তেয় হয়ে উঠে দেশের জন্য এক দুর্বিষহ গুরুভারে পর্যবসিত হবে। অর্থাৎ প্রকারান্তরে উন্নত দেশের ভেতরে অনুন্নয়নের কর্কটব্যাধি (ক্যান্সার) ছড়িয়ে দেবে, দেশকে করে তোলবে প্রকৃতপক্ষেই মরণাপন্ন।
বিদগ্ধমহলের অভিমত হলো, দেশের যে-কোনও অংশে শিশুদের শিক্ষাবঞ্চিত রেখে উন্নয়নের রাজপথে দেশের পা রাখার বিষয়টি প্রকৃতপ্রস্তাবে অন্তঃসারশূন্যতার আস্ফালন ভিন্ন আর কীছুই নয়। বৈষয়িক সম্পদ সঞ্চয়নের সঙ্গে মানুষের শিক্ষাসঞ্জাত আত্মিক সম্পদ কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক নিপুণতা অর্জিত না হলে বৈষয়িক সম্পদের যাবতীয় সম্ভার প্রকৃতপ্রস্তাবে একটি অপচয়ের মহাযজ্ঞে পর্যবসিত হয়। মনে রাখতে হবে, আধুনিকোত্তর উন্নত অর্থাৎ কথিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ চালাতে হলে বিজ্ঞানশিক্ষায় উত্তীর্ণ দক্ষ জনশক্তি চাই। টাঙ্গুয়ার পাড়ের কিংবা সারাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের শিশুকে শিক্ষাবঞ্চিত রেখে ডিজিটাল বাংলাদেশ চালাতে হলে দেশটিকে বিদেশিদের হাতে ইজারা দিয়ে দিতে হবে। সেটা কিন্তু মোটেও দেশের জন্য কোনও মঙ্গল বয়ে আনবে না। তাই বলি, অপর্যাপ্ত শিক্ষাবাজেট-এর পথ পরিহার করে, শিক্ষাবাজেট বাড়াতে হবে ব্যাপকাকারে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ছড়িয়ে দিতে হবে গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায়। বিভিন্ন প্রকার প্রকরণে বিদ্যমান অর্থ-অপচয় সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। যেমন বিদেশে গিয়ে খিচুড়ি রান্নার প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য কোনও আমলাকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া চলবে না। আমলাদের এইরূপ অর্থহীন ও আত্মসাৎপ্রবণ আমলামি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশের কোনও শিশুকে শিক্ষাবঞ্চিত রেখে দেশের উন্নয়নের মহাসড়কে পা রাখার বিষয়টি তা হলেই হবে অর্থবহ।