গত শুক্রবারের (১১ আগস্ট ২০২৩) দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদশিরোনাম ছিল, “হাওরে ভয়ঙ্কর জাল ‘চায়না দুয়ারি’র বিস্তার, হুমকিতে মৎস্যভা-ার”। শিরোনামের নিচেই লেখা হয়েছে, “চায়না দুয়ারি নামে ভয়ংকর এক জাল ছড়িয়ে পড়েছে হাওরাঞ্চলে। হালকা ও মিহি বুননের ছোট ফাঁসের এই জালে আটকা পড়ে মারা পড়ছে নানা প্রজাতির মাছ, পোনা। কম পরিশ্রমে বেশি মাছ ধরতে পারায় কারেন্ট জালের চেয়েও বিপজ্জনক এই জাল অসাধু জেলেদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে হুমকিতে পড়েছে হাওরের মৎস্য ভা-ার।”
এইটুকু তথ্যবার্তা জানার পর কারও মনে হতেই পারে যে, তারপর আর বলার কী থাকতে পারে? আসলেই কি তাই? উপরোক্ত শিরোনাম ও শিরোনামোত্তর বয়ার্ণনায় বিতথ্য পরিবেশিত হয়েছে।
আসলে আমাদের মৎস্যভা-ার নয় মৎস্যভা-ারের মৎস্যসহ জলজ জীবপ্রজাতির বিলুপ্তায়ান তরান্বিত হচ্ছে। অপরদিকে সমাজসংস্থিতির অভ্যন্তরে প্রকৃতিরক্ষার কোনও ব্যবস্থা সক্রিয় নয়। সমাজ ও প্রকৃতি রক্ষার আইন থাকলেও সে-আইন মাঠপর্যায়ে কাজ করছে না, অকেজোই থেকে যাচ্ছে বা অকেজো করে রাখা হয়েছে, সোজা কথায় বাস্তবায়িত হচ্ছে না। যেমন বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতির ভারসাম্যরক্ষার শর্তগুলো ইজারাদার কর্তৃক পালন করা হচ্ছে না এবং ইজারাদারকে সে-শর্ত পালন করানোর কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সুতরাং প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন যে-নদীর বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে তার অববাহিকার জনগোষ্ঠী। অথবা কোনও একটি শহরের পৌর এলাকায় ঘরবাড়ি নির্মাণের কতগুলো বিধিবিধান আছে, কিন্তু সে-গুলো মানা হচ্ছে না, কেউ না মানলে তার প্রত্যক্ষ কোনও প্রতিকার নেওয়া হচ্ছে না। কিংবা পৌর এলাকার পয়ঃজল নিষ্কাশনের প্রণালী নির্মাণে প্রাযুক্তিবিধি উপেক্ষা করা হচ্ছে এবং প্রকারান্তরে বর্ষায় জলজটের সৃষ্টি হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ সুনামগঞ্জ শহরকেই বিবেচনায় নিলে, দেখা যাবে যে এখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার ভূমিসীমানার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ছে পৌররাস্তার পরিসর কিংবা শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত খাল।
বোধ করি এর বেশি আর উদাহরণ উপস্থিত করার কোনও প্রয়োজন নেই। দেশের সামগ্রিক অবস্থা হৃদয়ঙ্গম করার জন্যে এই যথেষ্ট। অর্থাৎ উদ্দিষ্ট কহতব্য এই যে, আমাদের দেশে বাস্তব অবস্থাটা হলো : এখানে মানুষ তার প্রত্যক্ষ বৈষয়িক সুখ-সুবিধা ও উন্নতির স্বার্থে পরোক্ষে সমাজ ও প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করে চলেছে। মানুষ কর্তৃক বৃক্ষমূলে কুঠারাঘাতকে যেমন বলা হয়, মানুষ কর্তৃক মানুষের স্বীয়পদে কুঠারাঘাত, যা আত্মহত্যার সামিল। সমাজ ও প্রকৃতির এই ক্ষতিসাধন অব্যাহত আছে।
জলমহাল থেকে বালুমহাল হয়ে মানুষ এখন হাওরের মৎস্যস¤পদ আহরণের অন্তিমে এসে নদীর বালু উত্তোলনে মত্ত। উভয়ক্ষেত্রেই প্রকৃতি নিধনের মহাযজ্ঞ নির্বিঘেœ নি®পন্ন হচ্ছে , তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অর্থাৎ বলা চলে, চায়না দুয়ারি জাল দিয়ে মৎস্যনিধন করে প্রকারান্তরে জলমহালের মৎস্য নিধনের সমাপনী কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। পরিতাপের বিষয় এই যে, এইসব হচ্ছে, সমাজ-রাষ্ট্র-প্রশাসনের নাকের ডগায়। যে-সব সামাজিক, রাজনীতিক সংস্থা-প্রশাসন-প্রতিষ্ঠানের কর্তব্য ছিল সমাজ ও প্রকৃতিকে রক্ষা করা, সে-করণীয় কাজ তারা করছেন না। রক্ষক আইনের হাতিয়ার মানুষের হাতে ছিল, কিন্তু আইনের রক্ষকনীতিকে বিনাশীনীতিতে বদলে দেওয়া হয়েছে এবং সমাজ ও প্রকৃতির ক্ষতিসাধন অব্যাহত আছে। এমনটা চলতে পারে না। এর প্রতিরোধ চাই। প্রয়োজেনে সমাজনীতিকে বদলে দিতে হবে, বদলে দিতে হবে রাজনীতি ও অর্থনীতিকে। অন্যথায় পুঁজির পুঞ্জিভবনের পরিসরে মুষ্ঠিমেয় ধনীর সুখবিলাসিতার বলি হয়ে মানবসভ্যতাকে হত্যার অধিকার দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি নিতে হবে।