1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ০১:৪৮ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

‘আমি সরকারি কর্মচারী’ : আমীন আল রশীদ

  • আপডেট সময় বুধবার, ১২ জুলাই, ২০২৩

সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের গায়ক নচিকেতার একটি গান এরকম: ‘বারোটায় অফিস আসি দুটোয় টিফিন/তিনটেয় যদি দেখি সিগন্যাল গ্রিন/ চটিটা গলিয়ে পায়ে নিপাট নির্দ্বিধায়/ চেয়ারটা কোনোমতে ছাড়ি/কোনো কথা না বাড়িয়ে ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে/চারটেয় চলি আসি বাড়ি/ আমি সরকারি কর্মচারী।’
সব সরকারি কর্মচারীর ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য না হলেও তাদের ব্যাপারে গড়পরতা মানুষের ধারণা খুব বেশি ইতিবাচক যে নয়, তার বিবিধ কারণ রয়েছে।
সরকারি কর্মচারীদের বেতন যেদিন ১০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা এলো, তার কয়েক দিন পরেই জাতীয় সংসদে পাস হয় সরকারি চাকরি (সংশোধন) বিল-২০২৩; যে আইনে বলা হয়েছে, দায়িত্ব পালনস¤পর্কিত মামলায় সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে।
নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তুষ্ট রাখা বা ‘হাতে রাখা’র কৌশল নতুন কিছু নয়। কারণ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো তাদের মাধ্যমেই সম্পাদিত হয়। জাতীয় সংসদে যে আইন ও অন্যান্য নীতিমালা পাস হয়, সেগুলোর প্রাথমিক খসড়া সাধারণত সরকারি কর্মকর্তারাই প্রণয়ন করে থাকেন। আবার বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রণ, নির্বাচন পরিচালনাসহ অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজেও সরকারের বিভিন্ন বাহিনীকে সরকার কাজে লাগায়। ফলে তাদেরকে খুশি রাখার চেষ্টা সব আমলেই দেখা যায়। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এরকম ঘটনা ঘটে। যেমন গত মে মাসে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র ৫ দিন আগে সে দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন শতকরা ৪৫ ভাগ বাড়ানো হয়।
যদিও এটি ঠিক যে, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন নিয়ে অসন্তুষ্টি ছিল। তারা যে বেতন পেতেন, সৎভাবে জীবন-যাপন করলে শুধু ওই টাকায় সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকা কঠিন ছিল। সেই পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। যদিও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়লেও দুর্নীতি কমার কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। ‘জনপ্রশাসনে শুদ্ধাচার : নীতি ও চর্চা’ শীর্ষক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রভাবের কারণে জাতীয় শুদ্ধাচারের কোনো কোনো কৌশলের চর্চা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জনপ্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রবণতা বেড়েছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে যোগ্যতা নয় বরং ক্ষমতাসীনদের পছন্দ প্রাধান্য পাচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক পক্ষপাত, নানারকম দায়মুক্তির সুযোগ এবং আইনি কাঠামোর কারণে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে এমনিতেই বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে যে দেশে সরকারি অফিসগুলোয় ঘুষ ও দুর্নীতি ওপেন সিক্রেট, সে দেশের সরকারি কর্মচারীদের ফৌজদারি অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হলে সেটি অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আরও বেশি উৎসাহী করবে কি না, সেই প্রশ্ন উড়িয়ে দেয়া যায় না।
২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনেও এই বিধানটি ছিল। পরে আইনের কিছু শব্দ পরিবর্তন করা হয়। তবে আইনের ওই বিধানটিকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে এর বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর হাইকোর্ট রুল জারি করে আইনের ৪১ (১) ধারা কেন বাতিল এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চায়। যদিও পরে হাইকোর্টের এই রায় স্থগিত করে আপিল বিভাগ।
সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ বলছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। অর্থাৎ যে মামলায় একজন সাধারণ নাগরিককে গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয় না, সেই একই আইন ও একই মামলায় একজন সরকারি কর্মচারীকে গ্রেপ্তারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হলে এটি সংবিধানের এই বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক – এমন যুক্তিতে রিটটি দায়ের করা হয়েছিল।
তবে ব্যতিক্রম আছে। যেমন জাতীয় সংসদ সদস্যরা কিছু প্রিভিলেজ বা বিশেষ সুবিধা ভোগ করেন। সংসদ পরিচালিত হয় যে বিধানের (কার্যপ্রণালি বিধি) আলোকে, তার ১৭৪ ধারায় বলা হয়েছে, ¯িপকারের অনুমতি ছাড়া সংসদের সীমার মধ্যে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। এটি ব্যতিক্রম। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানের যে কোনো পর্যায়ের একজন কর্মীকে গ্রেপ্তারে যদি কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়, সেটিও একধরনের প্রিভিলেজ বা বিশেষ সুবিধা। সরকারি কর্মচারীরা এই প্রিভিলেজ ভোগ করতে পারেন কি না, সেটিই মূল তর্ক। আদালত রুল স্থগিত করার মধ্য দিয়ে এই তর্কের অবসান করলেও এ নিয়ে ভবিষ্যতেও আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হয়। কারণ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের খবর প্রতিনিয়তই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে জনবান্ধব হয়ে গেছে বা যাচ্ছে, তার লক্ষণ স্পষ্ট নয়। বরং কোথাও কোথাও পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হচ্ছে বলে শোন যায়। সুতরাং তাদের আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হলে অসৎ কর্মচারীরা আরও বেপরোয়া হবেন কি না, সেটিই উদ্বেগের।
যে কারণে ২০১৮ সালে যখন সরকারি চাকরি আইন সংসদে পাস হয়, তখন এই বিধানটিকে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের মূলচেতনা ও অভীষ্টের পরিপন্থী বলে দাবি করে টিআইবি বলেছিল, এই আইন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ঘোষিত শূন্য সহনশীল নীতির বিরোধী। তখন বিশেষজ্ঞদের তরফে বলা হয় যে, অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই আইনের সুবিধা নিয়ে আরও বেপরোয়া হবেন। শুধু তাই নয়, দুর্নীতি দমন কমিশনও এই বিধানের বিরোধিতা করে। কেননা দুদকের আইনে বলা আছে, অন্য আইনে যা-ই থাকুক না কেন দুদক আইন প্রাধান্য পাবে। কিন্তু সরকারি কর্মচারী আইন অনুযায়ী এখন দুদকও চাইলেও ফৌজদারি অপরাধে কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গ্রেপ্তার করতে পারবে না। তবে এটা ঠিক যে, পূর্বানুমোদনের বিধান থাকার অর্থ এই নয় যে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যা খুশি তা-ই করতে পারবেন। কারণ অপরাধের ধরনের ওপর নির্ভর করবে সরকার বা রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো তার সঙ্গে কী আচরণ করবে। এখানে আইনের চেয়েও বড় বিষয় ইনটেনশন বা নিয়ত এবং জনগণের সেবায় নিয়োজিত কর্মীরা তাদের চাকরিকে টাকা বানানোর মেশিন মনে করেন নাকি এটিকে দেশ ও জনগণের প্রতি পবিত্র আমানত মনে করেন, তার ওপর নির্ভর করে সেবাগ্রহীতার সঙ্গে তার আচরণ কী হবে? সুতরাং যারা সৎ এবং আইন মেনে কাজ করেন- তাদের জন্য কঠিন আইনও কোনো সমস্যা নয়। আবার যারা অসৎ তারা যেকোনো আইনের ফাঁক বের করেই অনৈতিক ও অবৈধ সুবিধা নিতে তৎপর থাকেন।
সংসদে যেদিন (৪ জুলাই) সরকারি কর্মচারী সংশোধনী বিলটি পাস হয় তার পরদিনই যুগান্তরের একটি সংবাদ শিরোনাম: ‘মধ্যরাতে বাবুগঞ্জ ছাড়লেন সেই ইউএনও’। খবরে বলা হয়, ঈদের আগের রাতে অনেকটা গোপনে ঢাকায় চলে গেছেন বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বিতর্কিত ইএনও নুসরাত ফাতিমা। মাত্র ১১ মাসের দায়িত্ব পালনকালে নানা অঘটনের জন্ম দেওয়া নুসরাত এবার যাচ্ছেন আমেরিকায়। ৪ বছরের শিক্ষা ছুটি পেয়েছেন তিনি। খবরে বলা হয়, গত বছরের ২৭ অগাস্ট বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায় যোগদানের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার আর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে শুরু করে। একের পর এক অঘটনে বারবার শিরোনাম হন গণমাধ্যমে।
তবে এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা, বিশেষ ইউএনওরা মোটামুটি নিয়মিত খবরের শিরোনাম হন। তার মধ্যে খারাপ খবরের সংখ্যাই বেশি।
সম্প্রতি বরিশালের আরেকটি উপজেলা বানারীপাড়ায় সন্ধ্যা নদীর সীমানা জরিপ ও নদীর জায়গায় থাকা দখল ও স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পাঁচ বছর আগে দেওয়া রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেছে, ‘রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কত দিন লাগবে? ১০০ বছর হলেও হয়তো হবে না।’
গণমাধ্যমের খবর বলছে, সন্ধ্যা নদী বাঁচাতে একটি রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ হাইকোর্ট কয়েক দফা নির্দেশনাসহ রায় দিয়েছিল। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি উল্লেখ করে মামলার বাদি বলেন, আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকেরা টালবাহানা করেন। এ সময় আদালত বলেন, ‘সচিব থেকে যা দেখছে, তা-ই শিখবে। সচিব তো কেয়ার করেন না। আদালত অবমাননার কয়েক হাজার মামলা পড়ে আছে।’ গত ২৮ মে গণমাধ্যমে এসেছে হাইকোর্টের এই কথা।
প্রশ্ন হলো, সচিব বা সরকারের আমলারা কেন আদালতের আদেশ মানেন না বা তাদের মধ্যে এই সাহস তৈরি হয় কীভাবে? আদালত কি ব্যক্তিস্বার্থে কোনো আদেশ দেয়? নদী, পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় আদালত যে আদেশ, নির্দেশ, রায় ও নির্দেশনা এবং পর্যবেক্ষণ দেন, সেগুলো দেশের স্বার্থে। মানুষের স্বার্থে। তাহলে মাঠ প্রশাসন কেন এগুলো আমলে নেয় না? তারা কি দেশ ও মানুষের স্বার্থের বিরোধী নাকি গুটিকয় প্রভাবশালীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে তারা আদালতের আদেশ নিষেধ না মানার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে দেশের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয়?
বলা হয়, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ চাইলে এক বছরের মধ্যে দেশের চেহারা বদলে যেতে পারে। একজন ডিসি বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চাইলে তিন দিনের মধ্যে তার এলাকার নদীপাড়ের যাবতীয় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা সম্ভব। আইনত সেই ক্ষমতা তাদের আছে। অনেক স্থানে এরকম উদ্যোগ নেয়াও হয়েছে। কিন্তু তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই কাজগুলো করেন না। কেন করেন না, সেই প্রশ্নের উত্তরও পাঠকের জানা আছে।
শুধু আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে গড়িমসি নয়, বরং কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সরকারি অফিসে নাগরিকদের হয়রানির মাত্রা যে কী ভয়াবহ, সেটি ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে ধারণা করা কঠিন। অনেক সময় বলা হয় বা দাবি করা হয় যে, থানার পরিবেশ নাকি আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। পুলিশ নাকি আগের চেয়ে অনেক বেশি জনবান্ধব। কিন্তু বাস্তবতা কী? প্রতিনিয়ত যেসব খবর গণমাধ্যমে আসে, মানুষের যেসব অভিজ্ঞতার কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা হয়, তাতে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, সেটি ইঙ্গিত করে না।
গত ৪ জুলাই সংসদে সরকারি চাকরি সংশোধন বিলটি পাসের আগে আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, জনপ্রশাসনে আজ চরম বিশৃঙ্খলা। তারা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স মানেন না। প্রজাতন্ত্রের কিছু কিছু কর্মচারী নিজেকে স্বঘোষিত মার্শাল আইয়ুব খান বা তার অনুসারী ভাবেন। তাদের ইচ্ছেমতো স্বাধীন ও জনস্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
সরকারি কর্মচারীদের বেতন হয় যে মানুষের ট্যাক্সের পয়সায়, সেই মানুষদেরকেই কোনো সার্ভিস দেয়ার বিনিময়ে যে ঘুষ নেন বা ঘুষ না দিলে যে দিনের পর দিন বা মাসের পর যে ঘুরান, এই যে সাহসটা পান, তার উৎস হচ্ছে নানারকম আইনি কাঠামো। আইন তাকে সব ধরনের সুরক্ষা দেয়। প্রতিটি আইনের শেষে লেখা থাকে সরল বিশ্বাসে কোনো কর্মকর্তা কর্মচারী এই আইনের ব্যত্যয় ঘটালে সেটি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে না। যে কারণে খুব ব্যতিক্রম ছাড়া যেকোনো অপরাধকেই সরল বিশ্বাসে কৃত বলে চালিয়ে দেয়া সম্ভব। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ অপরাধের তদন্ত করেন সরকারি কর্মকর্তারাই। কালেভদ্রে কিছু কিছু অপরাধের বিচার হয়, কারো কারো চকির যায়। কিন্তু অধিকাংশ অপরাধ আড়ালে থেকে যায়- এই অভিযোগ বহু পুরোনো।
গত বছরের জুন মাসে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কুড়িগ্রামের এক সাংবাদিককে সাজা দেয়া ও ‘নির্যাতনের’ ঘটনায় সারা দেশে আলোচিত জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীন সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়েছেন। কুড়িগ্রামে বাংলা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে বাড়ি থেকে ধরে এনে সাজা দেয়ার ঘটনায় তাকে দুই বছর বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করে লঘুদ-ের শাস্তি দিয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু সম্প্রতি সেই লঘুদ-ের শাস্তি বাতিল করে অভিযোগের দায় থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
সুতরাং যে দেশের সরকারি অফিসের সেবা নিয়ে মানুষের নেতিবাচক অভিজ্ঞতাই বেশি, সেই দেশের সরকারি কর্মচারীদের সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্র যখন আইনি কাঠামো আরও কঠিন করে তোলে; যে দেশে ঘুষ ছাড়া কোনা কাজ হতে চায় না, সেই দেশের সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা যদি কিছুদিন পরপর যদি বাড়ানো হয়, তাতে মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা যায়। মানুষ মনে করে, সরকারের কাছে তার নিজস্ব কর্মচারীরাই অগ্রাধিকার। সাধারণ মানুষ নয়। সরকারি চাকরিজীবীর বাইরে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বেসরকারি চাকরি করেন- তাদের সুরক্ষায় সরকারের নীতি ও পরিকল্পনা কী, সেটি নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে, সেখানে আশাবাদী হওয়ার মতো খুব বেশি উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে মানুষের মনে এই সন্দেহ আরও তীব্র হয় যে, সরকার কি শুধুমাত্র নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে সরকারি কর্মচারীদের খুশি রাখতে চায়?
মজার ব্যাপার হলো, সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে পূর্বানুমতির বিধান রেখে যেদিন আইনের সংশোধনী পাস হলো, একই দিনে সংসদে নির্বাচনী আইন আরপিও সংশোধনী বিলও পাস হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। বর্তমান আরপিও অনুযায়ী, অনিয়ম বা বিভিন্ন অপকর্মের কারণে ইসি যদি মনে করে তাহলে তারা নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এখন এই ক্ষমতা সীমিত করে শুধু ভোটের দিন অনিয়মের কারণে নির্দিষ্ট সংসদীয় আসনের ভোট বন্ধ করতে পারার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ইসিকে। অর্থাৎ রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর কোনো আসনের পুরো ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে না ইসি। যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ আসবে, শুধু সেসব ভোটকেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত করা যাবে। যদিও তদন্ত সাপেক্ষে ফলাফল বাতিল করে ওই সব কেন্দ্রে নতুন নির্বাচন দিতে পারবে।
স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়ম এবং নির্বাচন কমিশনের ভাষায় ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ চলে যাওয়ায় ভোট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই আসনে পরে আবার নির্বাচন হয়। ফলে গত ৪ জুলাই সংসদে আরপিও সংশোধন করে ‘ইলেকশন’ শব্দের বদলে ‘পোলিং’ শব্দ প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমানোর পেছনে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতাটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে কি না – সে প্রশ্নও অযৌক্তিক নয়। অবস্থাদৃষ্টে এমন হচ্ছে যে, সরকার একদিকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের খুশি রাখতে চায় এবং অন্যদিকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতা কমাতে চায় যাতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়?

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com