সালাম না দেওয়ার জন্যে মারধর করা কিংবা চায়ের দোকানের শিশুকর্মচারীর পরিবেশিত চায়ের পিরিচে চা জমে থকার কারণে পরিবেশকের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে আহত বা হত করার মতো ঘটনাও বাংলাদেশে কালেভদ্রে ঘটে যেতে দেখা যায়। পত্রিকায় পাঠ করা যায় এবংবিধ সহিংস ঘটনার লোমহর্ষক বিবরণ। এইসব ঘটনার পেছনে কোনও আর্থিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট থাকে না। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার উচ্চ থেকে নি¤œ স্তর পর্যন্ত যতো অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, ঘুষ, সম্পদপাচার, মাদকব্যবসা, জালিয়াতি, প্রতারণাা, দখল, দুর্নীতিসহ সর্বপ্রকার নৈতিকতা ও মানবিকতাবিরোধী কার্যকলাপ সংঘটিত হয় তার পেছনে কোনও না কোনও আর্থিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট থাকে। এইসব অপকর্ম যে হত্যা-গণহত্যা পর্যন্ত পর্যবসিত হয় না এমন কিন্তু নয়। যে-কোনও রাজনীতিক হত্যার পেছনে শেষ বিচারে রাজনীতির চেয়ে আর্থনীতিক কারণ অন্তর্নিহিত থাকে। ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ তেমনি একটি আর্থিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যুদ্ধ। অর্থাৎ বিশ্ব কিংবা বাংলাদেশের রাজনীতি অবশ্যই অর্থনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অর্থনীতির এই নিয়ন্ত্রণ এমনকি মানুষের বৈবাহিক সম্পর্কের সঙ্গে ওতপ্রোত, যেখানে নিয়ন্ত্রণটি যৌতুকের হিং¯্রতা নিয়ে আবির্ভূত। এই হিং¯্রতা এতোটাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে যে, ক্ষেত্র বিশেষে যৌতুক প্রত্যাশী স্বামী স্ত্রীকে হত্যা পর্যন্ত করে ফেলে। তাছাড়া এই পাষ- স্বামীর সঙ্গে হত্যাকা-ে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে তার পরিজনরাও, এমনটাও বিচিত্র নয়। পরিবারের সকলে মিলে গৃহবধূকে যৌতুক না পাওয়ার কারণে হত্যা করে ফেলেছে এমন ঘটনা বাংলাদেশে বিরল নয়। অর্থাৎ আসলে কালেভদ্রে নয়, প্রায় সচরাচর এমন ঘটনা রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘটেই চলেছে, গণমাধ্যম তার সাক্ষী।
গত বৃহম্পতিবার (৬ জুলাই ২০২৩) দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদশিরোনাম ছিল, ‘যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীকে হত্যা, স্বামীর মৃত্যুদ-’। যৌতুক না পেয়ে স্বামী যখন স্ত্রীকে হত্যা করে ফেলে তখন তার আর্থনীতিক অবস্থাটা কী? একবার ভেবে দেখুন। যৌতুক প্রত্যাশী এই পুরুষটি কী আমাদের দেশের অর্থলোভী (সকলে না হলেও কেউ কেউ) রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ীর মতো কেউ? উত্তরে নির্দ্বিধায় বলা যায়, নিশ্চয়ই না, আসলেই সে গরিব, ঘোষিত মাথাপিছু আয়ের শত কিংবা সহ¯্রভাগেরও নীচে তার আয়। প্রচলিত আর্থনীতিক ব্যবস্থা তাকে ক্রমে ক্রমে নিঃস্ব করে দিয়েছে। অবস্থা এমন যে, যৌতুক ভিন্ন তার জীবননির্বাহের জন্য কর্মসংস্থানের অভাবে দুর্গত এই দেশে নিজেকে ও বউকে ভাত খাওয়ানোরও কোনও আয়ের পথ খোলা নেই। এই পাষ- স্বামীকে সত্যিকার অর্থে অর্থলোভী বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে বিষয়টা অনেকটা এমন যে, সে উপায়ান্তর না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বউকে হত্যা করে ফেলেছে। কিন্তু চূড়ান্ত বিবেচনায় সে নিজেকেই হত্যা করেছে, অর্থাৎ নিজের বেঁচে থাকাকে অর্থহীন করে তোলেছে। বিদ্যমান অর্থনীতি তাকে কেবল দিয়েছে কাপুরুষতা।
আমাদের প্রশ্ন হলো, একটি উন্নয়নশীল দেশে যেখানে ক্রমাগত উন্নয়নের মাইল ফলক তৈরি হচ্ছেÑ মাথাপিছু আয় বাড়ছেÑ সেখানে উন্নয়নের আকাশচুম্বী উচ্চতার সঙ্গে গ্রামান্তরের মানুষের সম্পদহীনতা বিরাজ করবে কেন? এই বিত্তবৈভবের বৈষম্যের অবসান চাই। বৈষম্য থাকলে, বিবাহিত পুরুষের সামনে আয়রোজগারের সুলভ উপায় না থাকলে কেবল বউকে খুন করা নয়, বিভিন্ন অপরাধ তো বাড়বেই এমন কি আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে যাবে। সুতরাং সম্পদবৈষম্য দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থনীতিকে করে তোলতে হবে সব মানুষের জন্য বাঁচার অবলম্বন। তা হলেই যৌতুকের মতো অভিশাপ দেশ থেকে চিরতরে বিদায় নেবে।