গত শুক্রবারের (৯ জুন ২০২৩) দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি উদ্ধৃত সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘অ্যাসাইনমেন্টে নম্বর পেতে গাছ লাগাতে হবে’। সংবাদবিবরণীতে লেখা হয়েছে, ‘সারাদেশে তাপদাহ বহমান। রাজধানীর মানুষ পড়েছে চরম বিপাকে। বাতাস পেতে গাছের অভাব বোধ করছেন সবাই। তাই বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন অনেকেই। সেটিকেই গুরুত্ব দিয়েছে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ।’
বর্তমান বিশ্বজলবায়ুর প্রাতিবেশিক ভারসাম্যহীন ও জীবপ্রকৃতি বিনাশক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা সমুদ্রে শিশির কণা পরিমিত দানের সমতুল্য হলেও তাৎপর্যের দিক থেকে পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার প্রচেষ্টায় নিরত হওয়া ও উৎসাহ প্রদানে একটি অসীম গুরুত্ববহ ও বার্তাপ্রচারক কর্মপ্রযোগের দৃষ্টান্ত, তাতে কেনাও সন্দেহ নেই। আমরা জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়কে ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে ধন্যবাদ জানাই।
কিন্তু কথা হলো, ‘পুরইতে মন্ত্র পড়ে, পাঠা তো শোনে না’। অর্থাৎ বিষয়টা পরিণতিতে এরকম হয়ে পড়বে যে, ছাত্রদের লাগানো গাছগুলো কেটে ফেলবে কেউ না কেউ, যেমন কাটা হয়, এতোদিন কাটা হয়ে এসেছে, আইনের শাসনের আওতায়, প্রশাসন দেখেও দেখে নি, আইন নিশ্চেষ্ট থেকেছে বারবারের মতো। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার মানবিক দায়িত্ব থেকে বিশ্বব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন থেকেছে, পুঁজিবাদের অব্যাহত সম্পদসঞ্চয়ের নিরঙ্কুশ আধিপত্যের প্রতি আনুগত্যে সমর্পিত হয়ে। অদূর অতীতে বিশ্বজুড়ে বন কেটে বসত গড়া হয়েছে, প্রকৃতিবান্ধব বনবাসী জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে তথাকথিত আধুনিকতার বিস্তার ঘটানো হয়েছে দেশে দেশে। পাহাড় কেটে বাড়ি এবং গাছ কেটে সড়ক। এমন কি নদী-বিল-বাঁওড়গুলোকে মেরে ফেলা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটি পৌর এলাকার পুকুরগুলোকে ভরাট করে তাতে তোলা হয়েছে বড় বড় অট্টালিকাÑ খোলা হয়েছে বাণিজ্যকেন্দ্র। প্রকারান্তরে পুঁজিবাদ বানিয়েছে ইট-কনক্রিট-কাঠের শহর আর শ্রমিকের উদ্বৃত্তশ্রম শোষণের কলকারখানা, তার চাই কেবল মুনাফাÑ কোনও একজন পুঁজিপতির ভা-ারে জগতের সকল সম্পদ, যাতে তার শয্যাগুরু এক কোটি টাকা দামের আইসক্রিম খেতে পারে, ব্যক্তিগত বিমানে স্বল্পসময়ে ঘুরে আসতে পারে আস্ত পৃথিবী। জীবনে তার গতি চাই। এই গতি অর্জনের জন্য পৃথিবীর প্রাণপ্রকৃতি যদি ধ্বংস হয়ে যায় তার কীছু যায় আসে না। পুঁজিবাদের যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ মুনাফার আশ। পুঁজির প্রভুত্বের রাজত্বে এর কোনও অন্যথা নেই।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বলা হয়েছে, ‘কোর্সের অ্যাসাইনমেন্টে নম্বর পেতে আসন্ন ঈদুল আযহার মধ্যে একটি করে গাছ লাগাতে হবে শিক্ষার্থীদের।’ একজন শিক্ষার্থী বলেছেন, ‘ জলবায়ু পরিবর্তনে বর্তমানে সারা বাংলাদেশে যে তাপদাহ চলছে, তা প্রতিরোধে আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়ার উপযুক্ত সময় এসেছে। এমন অবস্থায় আমাদের শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের পারফম্যান্সের জন্য নির্ধারিত নম্বর পেতে গাছ লাগানোর নির্দেশনা দিয়েছেন।’
উত্তম কথা এবং কার্যক্রমটি অবশ্যই অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। জানা কথা, শিক্ষার্থীরা কয়েকটি গাছ লাগিয়ে দিলেই দেশে বর্তমানে চলা তাপদাহ এই মুহূর্তেই চিরতরে প্রতিহত হয়ে যাবে না। আসল কথা আগামী দিনগুলোতে যাতে তাপদাহের প্রাদুর্ভাব না ঘটে তার জন্যে সমাজ-রাষ্ট্রকে সম্মিলত কর্মপ্রয়াস চালাতে হবে। তাই শিক্ষার্থীটি বলেছেন, ‘বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়ার উপযুক্ত সময় এসেছে’। দেশের এক অংশ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় যুক্ত থাকবে আর অপরদিকে আর এক অংশ গাছ কেটে, পাহাড় কেটে, নদী-বিল দখল করে, বিল শুকিয়ে মাছ মেরে, বন উজাড় করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য অনবরত নষ্ট করবে এবং প্রশাসন তাদের কেশ স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারবে না, প্রকৃতির বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে জীবপ্রকৃতি তথা মানবপ্রজাতির বিরুদ্ধে আপরাধ করে তারা পার পেয়ে যাবে, তা হতে পারে না। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী তার বক্তব্যে এই ইঙ্গিতটি দিয়েছেন। আমরা তাঁকে সমর্থন করছি।