তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের ঘাগটিয়া গ্রামে গত ২৪ এপ্রিল রাত ১০টায় রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দিয়ে এক যুবককে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করার সময়ে যুবকের বাবা ছেলের প্রাণভিক্ষা চাইতে গিয়েছিলেন, তাঁকেও মারধর করা হয়েছে, তিনি প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। বাড়িতে এসে মানুষজনকে জানিয়েছেন বটে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। যুবকের লাশ কে বা কারা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তাহিরপুর থেকে সুনামগঞ্জে, সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট নিয়ে গেছে। অনুমান করা হচ্ছে পূর্ববিরোধের জেরে এই ঘটনা ঘটেছে। অভিযুক্ত হত্যাকারী পক্ষের প্রধান এলাকায় খুবই প্রভাবশালী, ক্ষমতাধর, ধনাঢ্য ও ক্ষমতাসীন রাজনীতিক দলের লোক, রাজনীতিক দলের ক্ষমতায় ক্ষমতাবান। গণমাধ্যম বলছে ঘটনা সম্পর্কে সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে নারাজ। থানায় মামলা হয়েছে। গত শুক্রবার (২৮ এপ্রিল) পর্যন্ত কোনও গ্রেফতার নেই। পুলিশ ঘটনাস্থল ঘুরে গেছেন।
পরবর্তী পরিস্থিতি সিনেমার ঘটনার মতো গড়াতে গড়াতে গড়বড়ে হয়ে গেলে আশ্চর্য হওয়ার কীছু নেই। হয় তো দেখা যাবে চার্জসিট দাখিল করতে করতেই বিচারপ্রার্থীদের জীবন কেটে গেল এবং যথারীতি আইন আইনের গতিতে চলতে থাকলো। প্রকারান্তরে প্রমাণ হলো টাকা হলে সবই হয়, খুন করেও রেহাই পাওয়া যায়, যা ইচ্ছে তাই করা যায়, সমাজটাকে পায়ের তলায় পিষে ফেলা যায়।
সমাজের কোনও সদস্য অন্য কোনও সদস্যের দ্বারা হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রান্ত হলেও সমাজের সাধারণ সদস্যরা তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে না, কোনও প্রতিবাদ করে না, বরং নীরব থাকে। পুঁজিবাদ ও পুঁজিবাদী রাজনীতির টাকা পূজারি প্রতিনিধি কেবল শোষক হয়ে উঠে ধনাঢ্য হওয়া ছাড়া আর কীছুই হতে পারে না। মসজিদ-মন্দিরে সে টাকা দেয় চুরি-চামারির টাকা থেকেই। যে-টাকা অন্য মানুষের আয়ের ভাগ থেকে কেড়ে নেওয়া হয় বিভিন্ন রাজনীতিক, আর্থনীতিককরণ কৌশল প্রয়োগ করে কাঠামোগত পদ্ধতিতে। যে-পদ্ধতিতে চুরি-ডাকাতিকে অনায়াসে বৈধ করে নেওয়া যায়। মানুষকে মানুষের শোষণ করার এই পুঁজিবাদী পদ্ধতি প্রবণতা মানুষের মনুষ্যত্বকে ক্রমাগত ক্ষয় করে, মানুষকে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, মানুষের মধ্যে শুভ আচরণের স্থলে অশুভ আচরণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং প্রকারান্তরে মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ব্যক্তি মানুষকে কার্যত কাপুরুষে পরিণত করে আসলে পুরো সমাজটাকেই কাপুরুষে পরিণত করে। সাকিবকে যখন হত্যা করা হয় তখন, গ্রামবাসী এই কারণে নীরব ছিল।
ঘটনাটি আইনের টানাপোড়নের ঠেলাধাক্কায় পড়ে বেহাল দশায় নিপতিত হয়ে বিচারপ্রাপ্তিকে দীর্ঘসূত্রিতার পাকেচক্রে ফেলে দিতে পারে এবং এমন হতেই পারে, বিচিত্র নয়। ভুলে গেলে চলবে না, এটি একটি সামাজিক অস্থিরতার নমুনা। এমন ঘটনার নমুনা বাংলাদেশের রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত যে-কোনও স্থানে আজকাল নৈমিত্তিক ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে এবং ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। সমাজসংস্থিতির সামগ্রিক পরিসরে যখন বিচারহীনতার সংস্কৃতির ভেতরে জোর যার মুল্লুক তার অবস্থা বর্তমান থাকে তখন এমনটাই স্বাভাবিক। অবাক হওয়ার কীছু নেই।
পুঁজিবাদ মানুষকে স্বার্থদ্বন্দ্বের অন্ধ ধান্ধা তাড়নায় ফেলে এই সমাজকে কাপুরুষ সমাজে পর্যবসিত করে দিয়েছে। এ সমাজ অমানবিকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত শ্রেণিবৈষম্যের সমাজ। এখানে শ্রেণিবৈষম্যহীনতা ও সাম্যতার আলো দিতে হবে। কিন্তু মনে হচ্ছে, অন্ধকার দূর করবার আলোর মশাল যার হাতে তার আসতে এখনও বেশকীছু দেরি আছে, এখনও তাঁর আসার সময় হয়নি। তাঁর পূর্বসূরিরা এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন, কিন্তু ঘাগটিয়া গ্রামের মতো সমাজের প্রতিটি কোণায় ঘাপটি মেরে থাকা পুঁজিবাদের প্রতিনিধি প্রভাবশালী ক্ষমতাধরদের বিরোধিতার চাপে নিজেরা ব্যস্ত হয়ে আছেন। অগত্যা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সমাজের সকল মানুষের কাছে এই আবেদন রাখছি যে, আপনারা সাকিব হত্যার মতো ঘটনাকে ছেড়ে দেবেন না, সমাজটাকে বদলাতে না পারেন অন্তত প্রচলিত আইনে এই অপরাধের দ-প্রাপ্তি নিশ্চিত করুন।