বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে দুর্নীতি নিয়ে যতো কথাবার্তা হয়েছে কিংবা সম্পাদকীয় নিবন্ধসহ অন্যান্য লেখালেখি হয়েছে, আর অন্য কোনও বিষয় নিয়ে বোধকরি, এতো বেশি করে লেখালেখি হয়নি। পরিসংখ্যান নিলে হয় তো দেখা যাবে যে, বাংলাদেশের মানুষ দুর্নীতিচর্চায় বেশি পারদরঙ্গম (পারদর্শী+পারঙ্গম) এবং জীবন নির্বাহের জন্যে এখানে যে সামাজিক-আর্থনীতিক কাঠামো গড়ে উঠেছে বাগড়ে তোলা হয়েছে সেটার সঙ্গে দুর্নীতি অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ রূপে যুক্ত হয়ে আছে বা যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সার্বিক অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সব কথার শেষ কথা হলো, দেশে কোনও মানুষই দুর্নীতির বাইরে গিয়ে জীবনযাপন করতে পারেন না, সেটি একটি অসম্ভব ব্যাপার। এ দেশে মানুষের জীবন দুর্নীতির বুনিয়াদি কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আছে। যাঁরা সৎ জীবনযাপনে অভ্যস্ত তাঁরা প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রত্যক্ষ নয় তবে পরোক্ষে প্রতিনিয়ত দুর্নীতির সঙ্গেই বসবাস করতে অভ্যস্ত কিংবা বলা যায় বাধ্য হচ্ছেন। এইটুকু মেনে না নিয়ে তাঁরা তাঁদের জীবন চালাতে পারছেন না এবং চালাবার জন্য কোনও পথ খোলা নেই। একজন পরহেজগার মানুষ তাঁর জীবন চালাবার জন্যে আর একজন দুর্নীতিবাজের দফতরে কাজ করেন এবং কাজটাও দুর্নীতিরই কাজ, তিনি সব কীছু বুঝেন কিন্তু গত্যান্তর না থাকার কারণে ওই দুর্নীতির কাজই করেন এবং দিন শেষে তাঁর পরিশ্রম থেকে প্রাপ্য রোজগারকে সৎ উপায়ে উপার্জন বলেই মনে করেন। এই অনিবার্যতার মধ্যেই তিনি তাঁর পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকেন। এর বাইরে যাবার তাঁর কোনও উপায় নেই। তিনি যে সামাজিক-আর্থনীতিক কাঠামোর ভেতরে বাস করেন সেখানে সৎভাবে বাঁচার কোনও বিকল্প পথ নেই বা রাখা হয়নি। বিস্তর আলোচনার অবকাশ এই সম্পাদকীয় নিবন্ধের পরিসরে নেই। কেবল বলি, দুর্নীতি আমাদের দেশের মানুষের রক্তে ও মনে মিশে গিয়ে জীবনের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে, কোনও সন্দেহ নেই। দুর্নীতির সঙ্গে জীবন একাকার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়, যখন প্রতিটি ফেয়ার প্রাইজ কার্ড নিবন্ধনের জন্য সরকার নির্ধারিত উদ্যোক্তার প্রাপ্য ১৫ টাকা থেকে লাফিয়ে ৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে যায়, যেখানে সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এই নির্ধারিত ১৫ টাকা সরকার নিজেই পরিশোধ করবেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে যে, কার্যক্ষেত্রে কম পক্ষে ৩৫০ টাকা (ক্ষেত্রবিশেষে সেটা ৪৫০ কিংবা ৫০০ টাকা হয়ে যাচ্ছে) আদায় করা হচ্ছে ফেয়ার প্রাইজ কার্ড নিবন্ধন করতে আসা অতিদরিদ্রদের কাছ থেকে। অন্যথায় অতিদরিদ্ররা ফেয়ার প্রাইজ কার্ড করতে পারছেন না এবং প্রকারান্তরে সরকারি কাজে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মতৎপরতা চালানো হচ্ছে, শেখ হাসিনার উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য। গত মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর ২০২২) এক দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘ফেয়ার প্রাইজ কার্ড নিবন্ধনে অর্থ আদায়ের অভিযোগ’। সংবাদে বলা হয়েছে, ‘জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নে অতিদরিদ্রদের মাঝে পনের টাকা কেজি মূল্যের চাল বিতরণের জন্য ফেয়ার প্রাইজ কার্ডের অনলাইন নিবন্ধনে অর্থ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।’ এবংবিধ সংবাদ পরিবেশনের পর আমাদের বলার কীছু থাকে না। দুর্নীতি দমনের জন্যে ইতোমধ্যে দেশের গণমাধ্যমে অনেক কীছুই বলা হয়েছে, নতুন করে বলার কীছু নেই। তাই ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা’র সেই পুরনো কথাটি বলেই আজকের সম্পাদকীয়র ইতি টানছি।