শামস শামীম ::
ছায়ার হাওর। নামটি শুনে মনে হতে পারে হাওরটি কেবলই ছায়াময়। সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ নিয়ে বিস্তৃত এই হাওরের বেশিরভাগ ফসলি জমিই শাল্লা উপজেলায়। হাওরের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা লোকালয় ছাড়া কোন ছায়ার ব্যবস্থা নেই। নেই জলাবন হিজল করচের বাগ। বর্ষায় সাগরে রূপ নেওয়া এই হাওরটি ঝড় আফাল ও বজ্রপাতের তাণ্ডবে ভয়াল হয়ে ওঠে। তখন থৈথৈ জলের এই হাওরে যাত্রীবাহী নৌকা, মাছধরার জেলে নৌকার লোকজন মৃত্যুর মুখে নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। একইভাবে বৈশাখে ধান কাটা ও মাড়াইয়ে মগ্ন কৃষক দুরন্ত কালবৈশাখী থেকে সাময়িকভাবে নিজেকে রক্ষার জন্য কোন আশ্রয় খুঁজে পাননা। ফলে অসহায় হাওরবাসী দুর্যোগ ও দুর্বিপাকে প্রকৃতির উপরই ভরসা করে থাকেন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বিপন্ন হাওরবাসীর কথা চিন্তা করে এবার দুর্গম হাওরগুলোতে নির্মিত হচ্ছে দ্বিতল বিশিষ্ট প্রায় ১৮.৪০ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ‘হাওর আশ্রয়কেন্দ্র’। যেখানে বর্ষায় ঝড় বানে বজ্রপাতে নাকাল কৃষক জেলে ও সাধারণ মানুষ আপৎকালীন আশ্রয় নিতে পারবেন। আশ্রয়কেন্দ্রের উপরে রয়েছে বজ্রনিরোধ দণ্ড ও সৌর আলোর ব্যবস্থা। তবে এই হাওর আশ্রয়কেন্দ্র এখন দুর্গম হাওরগুলোর সৌন্দর্য্যও বাড়িয়ে দিয়েছে। জলের কান্তারে দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্থাপনা হয়ে। অনেকে সেখানে এসে সপরিবারে আনন্দভ্রমণও করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি শাল্লার ছায়ার হাওর ঘুরে এমন দুটি আশ্রয়কেন্দ্রে দেখা গেল বিপন্ন হাওরবাসীকে আশ্রয় নিতে।
সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকারের উপ পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে হাওরবাসীর কি কি সমস্যা হচ্ছে তা জানার উদ্যোগ নেয় সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার বিভাগ। বিভিন্ন স্থানে গণশুনানীতে গিয়ে উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, কৃষক, জেলেসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেন সংশ্লিষ্টরা। হাওরবাসী বজ্রপাত, আফাল, কালবৈশাখীসহ প্রাকৃতিক নানা তাণ্ডবে তাদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন। হাওরবাসীর এই সমস্যা সমাধানে দুর্যোগে কিভাবে সাময়িক আশ্রয় দেওয়া যায় তার পরিকল্পনা করেন সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকারের উপ পরিচালক মো. জাকির হোসেন। তিনি দুর্গম হাওরে এই আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টি অবগত করেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। কর্তৃপক্ষও যুগপোযুগী এই আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়। হাওরবাসীর মতামত নিয়ে এই আশ্রয়কেন্দ্রে গভীর নলকূপ ও সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ছাদের উপরে বসানো হয়েছে বজ্রনিরোধক দণ্ড। প্রতিটির ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা। গত বৈশাখে কাঠফাটা রোদে এই আশ্রয়কেন্দ্রে বসানো নলকূপ থেকে পানির চাহিদা মিটিয়েছেন কৃষকরা। এই অর্থ বছরে জেলার তিনটি উপজেলায় ৮টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের হাত দেয় সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার বিভাগ। লোকাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (লজিক) প্রকল্প থেকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দুর্যোগ দুর্বিপাকে বিপন্ন হাওরের কৃষক, জেলে ও নৌ যাত্রীদের হাওরে সাময়িক আশ্রয়ের জন্য শাল্লা উপজেলার ধোপাজোরা হাওরে ১টি, দীঘলবন্দ হাওরে ১টি, ছায়ার হাওরে ২টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে কাজ শুরু হয়। ইতোমধ্যে ছায়ার হাওরের দুটি আশ্রয়কেন্দ্রের কাজ শেষ। এছাড়াও দিরাই উপজেলার কালিয়াকোটা হাওরে ১টি, তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ বড়দল ইউনিয়নের মাটিয়ান হাওরে ১টি, বালিজুড়ি ইউনিয়নের শনির হাওরের জাঙ্গালে ১টি, শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের মাটিয়ান হাওরের কান্দায় একটি হাওর আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু আগাম বর্ষার কারণে কাজ শেষ করা যায়নি। বর্ষা শেষ হলে দ্রুত এগুলোর কাজ শেষ করা হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন গত বৃহস্পতিবার শাল্লা উপজেলার আটগাঁও ইউনিয়নের মাহমুদ নগরের ছায়ার হাওরের কান্দায় গিয়ে দেখা যায়, দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে আছে একটি দ্বিতল খোলা স্থাপনা। স্থাপনাটি শাল্লা উপজেলার আটগাঁও ইউনিয়নের মাহমুদনগর গ্রামের পাশে কান্দায় নির্মিত হয়েছে। এই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পশ্চিমে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রাম। দক্ষিণে কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন এলাকা।
দেখা গেল- ছায়ার হাওরের বিশাল ঢেউ আঘাত করছে স্থাপনার কলামে। দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনার চারদিকে দেয়া হয়েছে স্টিলনেস পাইপ। পুরো স্থাপনাটিই আকর্ষণীয়ভাবে রঙকাজ করা হয়েছে। সেখানে স্থাপন করা হয়েছে একটি গভীর নলকূপ। এসময় দেখা গেল নৌকা ভিড়িয়ে দুই জেলে গভীর নলকূপ থেকে পানি পান করছেন। আরও কয়েকজনকে দেখা গেল মেঝেতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। আশ্রিতরা জানালেন এই স্থাপনাটি বর্ষার দুর্যোগে কাজে দিয়েছে। এখন হাওরে আফাল (উত্তাল ঢেউ) ওঠলে ঢেউয়ের দানবীয় তাণ্ডব ও বজ্রপাত থেকে এখানে নৌকা ভিড়িয়ে আশ্রয় নিতে পারছেন। একই সঙ্গে রাত দিন মাছ ধরায় নিয়োজিত জেলেরাও দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে এখানে নিয়মিত এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। তারা জানান, শাল্লা উপজেলার এক প্রান্তে ছায়ার হাওরের কান্দায় এটি নির্মিত হলেও পার্শ্ববর্তী কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, মিঠামইন ও নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুড়ি এলাকার মানুষজনও দুর্যোগ সময়ে আশ্রয় নিতে পারছেন।
এসময় হাওর আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া যাত্রী মাহমুদনগর গ্রামের আক্তার হোসেন বলেন, এটি হাওরবাসীর দুর্যোগকালীন একটি প্লাটফর্ম হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বজ্রপাত, কালবৈশাখী ঝড়, আফাল থেকে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছে আমাদেরকে। এ ধরনের স্থাপনা দুর্গম হাওরগুলোতে আরো বেশি করে করা উচিত। এগুলো অসহায় হাওরবাসীর কাছে এখন ভরসার প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছে।
একই গ্রামের মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, হাওর আশ্রয়কেন্দ্র এখন আমাদের মধ্যে দুর্গম হাওরে সাহস যোগাচ্ছে। জরুরিকাজে জেলা ও উপজেলা সদরে বেরুলে যখন তখন ঝড় ও বজ্রপাতে আমরা মৃত্যুর মুখে থাকি। প্রাকৃতিক কারণেই আমাদের আশ্রয় নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ভরা বর্ষায় অকুল হাওরে ঝড়ের মুখে আমরা আল্লা রসুল শাহ আরেফিন শাহজালালের নাম নেই। আশ্রয় নেওয়ার কোন সুযোগ পাইনা। এখন এমন যুগপোযোগী স্থাপনা মনে সাহস জুগিয়েছে।
মাহমুদনগর গ্রামের বিরাজ মিয়া বলেন, আমাদের নিরাপত্তার জন্য হাওর আশ্রয়কেন্দ্র বেশ কাজ দিচ্ছে। এখন প্রতিদিনই এই আশ্রয়কেন্দ্রে কৃষক জেলে ও যাত্রীরা সময়ে সময়ে আশ্রয় নিতে পারছেন। আশ্রয়ের সঙ্গে তারা বিশুদ্ধ পানিও পান করতে পারছেন। বৈশাখ মাসেও ধান কাটা ও মাড়াইয়ের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয়ের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মিটিয়েছি।
সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো. জাকির হোসেন বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগে কাজ করতে এসে মাঠে বেশি আসতে হয়েছে। তখন দুর্গম হাওরগুলোর সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে তাদের বহুমুখি সমস্যার কথা অবগত হই। তাই আমি পরিকল্পনা নেই হাওর আশ্রয়কেন্দ্র করার। লজিক প্রকল্প থেকে ইতোমধ্যে তিনটি উপজেলায় ৮টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণকাজ চলছে। তিনটির কাজ শেষ। বন্যার পানি কমে গেলে এগুলোর কাজও দ্রুত শেষ হবে। তিনি বলেন, আগামীতে যে কাজগুলো হবে সেগুলোতে আরও নানা বিষয় যুক্ত হবে যাতে এগুলো টেকসই করা যায়।