সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
দেশে ২০০৮ সাল থেকে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু হয়। কিন্তু ১৪ বছর পার হওয়ার পরও এখনো ৪১ শতাংশ শিক্ষক এই পদ্ধতি বোঝেন না। তারা অন্য কোনো শিক্ষকের সহায়তায় প্রশ্ন প্রণয়ন করেন বা অন্য কোথাও থেকে প্রশ্ন কিনে আনেন। এমনকি পাঠ্যক্রমের ওপর ৩৫ শতাংশ ও সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর ৩৮ শতাংশ শিক্ষকের প্রশিক্ষণ নেই। যেহেতু শিক্ষকদেরই অনেকে সৃজনশীল বোঝেন না, তাই মাধ্যমিকের অনেক শিক্ষার্থীই এখনো দুর্বল। যাদের ব্যাপারে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও আলাদা কোনো উদ্যোগ নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের অ্যাকাডেমিক সুপারভিশন রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বর মাসের তথ্য নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার একিউআই সেল। এই প্রতিবেদন তৈরিতে দেশের ৪ হাজার ৭৬টি বিদ্যালয় থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
সুপারভিশন রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ৪ হাজার ৭৬ বিদ্যালয়ের ৫৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ শিক্ষক নিজেরাই সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সহায়তায় প্রশ্ন প্রণয়ন করেন ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ শিক্ষক। বাইরে থেকে সৃজনশীল প্রশ্ন সংগ্রহ করেন ২৩ দশমিক ১৬ শতাংশ শিক্ষক। অর্থাৎ প্রায় ৪১ শতাংশ শিক্ষক ঠিকমতো সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না। তবে সৃজনশীল পদ্ধতিতে বিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রশ্ন প্রণয়নের হার সবচেয়ে বেশি সিলেটে ৭১ দশমিক ০৭ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম বরিশাল অঞ্চলে ৩৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
সৃজনশীল না বোঝার পেছনে অন্যতম কারণ শিক্ষকদের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাব। ৪ হাজার ৭৬ বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রশিক্ষণের রেজিস্টার সংরক্ষণ করেছে ৩ হাজার ২৮৮ বিদ্যালয়। এসব বিদ্যালয়ে ৫৬ হাজার ১১৬ জন শিক্ষকের মধ্যে বিএড (ব্যাচেলর অব এডুকেশন) প্রশিক্ষণ আছে ৪৩ হাজার ৫৭১ জনের। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে প্রশিক্ষণ আছে ২৯ হাজার ৩৮৬ জনের। ক¤িপউটার প্রশিক্ষণ আছে ২২ হাজার ৪০৭ জনের। পাঠ্যক্রমের ওপর প্রশিক্ষণ আছে ৩৬ হাজার ৪৭১ জনের। অর্থাৎ ৩৫ শতাংশ শিক্ষকেরই পাঠ্যক্রমের ওপর প্রশিক্ষণ নেই। আর সৃজনশীলে প্রশিক্ষণ আছে ৩৪ হাজার ৯৬৩ জনের। অর্থাৎ ৩৮ শতাংশ শিক্ষকেরই সৃজনশীলে প্রশিক্ষণ নেই। অথচ গত ১৪ বছর ধরে তারা সৃজনশীল পড়িয়ে যাচ্ছেন।
সুপারভিশনকৃত বিদ্যালয়ে এক বা একাধিক বিষয়ে ৩০ শতাংশের কম নম্বর পেয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। তবে কত সংখ্যক শিক্ষার্থী তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু দুর্বল শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এমন বিদ্যালয় ৬৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। দুর্বল শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয় না এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৩ দশমিক ০৬ শতাংশ। আর দুর্বল শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে না আবার কোনো ব্যবস্থাও নেয় না এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ।
আগে বেসরকারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ দিত বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ। তখন শিক্ষক নিয়োগে নানা অনিয়মের অভিযোগ ছিল। আর্থিক সুবিধা ও আত্মীয়করণই ছিল শিক্ষক নিয়োগের প্রধান যোগ্যতা। ফলে অনেক অদক্ষ শিক্ষক এখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছেন। যাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও নেই। আবার অনেক শিক্ষক রয়েছেন যাদের সৃজনশীল আত্মস্থ করারই ক্ষমতা নেই। তাদের যতই প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক না কেন তারা তা ধরে রাখতে পারছেন না। ফলে শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন সৃজনশীল বুঝে উঠতে পারছে না। তবে এখন সরকার বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে। এতে অনেক মেধাবী এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু আগে নিয়োগ পাওয়া অনেক শিক্ষক কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে দিন পার করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুমোদন করেছেন। এ বছর থেকে তা পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে (পাইলটিং) চালু করা হয়েছে। আগামী বছর থেকে এই নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। এই পাঠ্যক্রমে পরীক্ষার চেয়ে শ্রেণিকক্ষে শিখন কার্যক্রম ও মূল্যায়নে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রায় ৪১ শতাংশ শিক্ষক যারা নিজেরাই সৃজনশীল বোঝেন না তারা কীভাবে শ্রেণিকক্ষে শিখন ও মূল্যায়ন কার্যক্রমকে জোরদার করবেন তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।
অ্যাকাডেমিক সুপারভিশনের সুপারিশেও বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হলে বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। নিজেরাই যাতে প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারেন সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সদ্য অবসরে যাওয়া মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, এখন শিক্ষক নিয়োগ দেয় এনটিআরসিএ। এতে আগের চেয়ে আমরা দক্ষ শিক্ষক পাচ্ছি। সৃজনশীল এমনিতেই কিছুটা কঠিন। এজন্য আরও বৃহৎ পরিসরে প্রশিক্ষণ হওয়া উচিত। তবে নতুন কারিকুলামে (পাঠ্যক্রম) ধারাবাহিক মূল্যায়নে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। ফলে সে ব্যাপারে এখন থেকেই আমাদের শিক্ষকদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্যও প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। -দেশ রূপান্তর