শহীদনূর আহমেদ ::
হাওরে বজ্রপাত মৃত্যু আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। গত ৫ বছরে শতাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। একই সাথে বাড়ছে নিহতের সংখ্যা। এই নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
চলতি বোরো মৌসুমে ধানকাটাসহ কৃষি কাজ করতে গিয়ে একই পরিবারের পিতা-পুত্রসহ অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ ১৯ মে তাহিরপুরের সুন্দর পাহাড়ি গ্রামে বাদাম তুলতে গিয়ে ৩ শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। একই ঘটনায় আরও ৮জন আহত হন। এর আগের দিন ১৮ মে ধর্মপাশা উপজেলার পাইকুরহাটি ইউনিয়নে জামালপুর গ্রামে ধান কাটতে গিয়ে বজ্রাঘাতে মতিউর রহমান (৪২) নিহত হন। ১৩ মে ধান সংগ্রহ করতে গিয়ে বজ্রপাতে শান্তিগঞ্জ উপজেলার পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের কাড়ারাই গ্রামে সুবহান নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়। এসময় আরও ২জন গুরুতর আহত হন। ২২ এপ্রিল দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নে ধীতপুর গ্রামে ধান কাটার সময় আকস্মিত বজ্রপাতে রবীন্দ্র দাস (৬০) ও টিপু দাস (২৩) নিহত হন। ১৫ মে বাড়ির পাশের জমিতে ধান কাটার সময় বজ্রাঘাতে শাল্লা উপজেলার নাছিরপুর গ্রামের মকবুল খাঁ ও মাসুদ খাঁ নামের পিতাপুত্রের মৃত্যু হয়।
সংশ্লিষ্ট থানা ও জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে বজ্রপাতে ১২ জন নিহত ও ১৩ জন আহত, ২০২০ সালে নিহত হন ১০ জন ও আহত এক। ২০১৯ সালে বজ্রাঘাতে ১২ জন নিহত ও আহত হন আরও ১৩ জন। ২০১৮ সালে হাওরে কৃষিকাজ ও মাছ ধরতে গিয়ে ২৫ জন এবং ২০১৭ সালে আরও ২৫ জনের মৃত্যু হয়। এই দুই বছর পর পর সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হয়।
আবহাওয়া অফিস বলছে, দেশের সবচেয়ে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা সুনামগঞ্জ। গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলে বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনসহ এ অঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক অবস্থানকেও দায়ী করছেন আবহাওয়াবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।
২০১০ সালের পর দেশে বজ্রপাত বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। ২০১৬ সালে পরপর দুদিনে বজ্রপাতে ৮১ জনের প্রাণহানি ঘটে। এরপরই বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে মন্ত্রণালয়। প্রতিবছরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে দুই কোটিবার বজ্রপাত হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০৫০ সালে গিয়ে বজ্রপাতের সংখ্যা দাঁড়াবে তিন কোটিতে। এ অবস্থায় ক্ষয়ক্ষতিও বাড়বে।
গবেষকদের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। এতে বজ্রপাতের ঝুঁকিও সমান হারে বাড়বে। এছাড়া বজ্রপাতের কারণ হিসেবে বায়ুদূষণকেও দায়ী করেছেন তারা। এখনই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে হাওর অঞ্চল সুনামগঞ্জের জন্য বজ্রপাত বড় দুর্যোগে রূপ নিবে। এতে প্রাণহানিসহ মানবিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, হাওরে শীঘ্রই আধুনিক ‘বজ্রনিরোধক পোল’ বসানো জরুরি। বজ্রনিরোধক খুঁটি বা পোল স্থাপন আর মানুষকে সচেতন করার মধ্য দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যাবে।
জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, বজ্রপাত রোধে সুনামগঞ্জের প্রতি উপজেলায় অন্তত একটি ও কোনো কোনো উপজেলায় একাধিক ‘বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনে একটি প্রকল্প ইতোমধ্যে পাস হয়েছে। বরাদ্দও দেয়া হয়েছে। আশা করছি দ্রুতই কাজ শুরু হবে। এই প্রকল্প কতখানি বাস্তবিক ও ফলপ্রসূ তা জানা যাবে। সফল ভালো হলে ভবিষ্যতে এই কার্যক্রম আরও বেগবান করা হবে বলে।
আবহাওয়াবিদ সাইদ আহমদ চৌধুরী জানান, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে মূলত বজ্রপাত বাড়ছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল দ্রুত গরম হয়ে যাওয়ায় মেঘ তৈরির স্বাভাবিক পরিবেশ থাকছে না। আর দ্রুত মেঘ তৈরির সময়ে বাড়ছে বজ্রপাত। উচ্চ তাপমাত্রার কারণে বায়ুমণ্ডল দ্রুত গরম হয়ে যায়। তখন সিভি ক্লাউড বা বজ্রমেঘের পরিমাণও বাড়ে। জলীয় বাষ্পগুলোকে নিয়ে ভূমির গরম বাতাস যখন তীব্র বেগে ওপরে ওঠে তখন দ্রুত এ বাষ্প শীতল হয়ে যায়। এই শীতল পানির কণাগুলো এরপর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে নিচে নামতে থাকে। কিন্তু নিচে থেকে গরম বাতাসের চাপে এগুলো আবার গলে বাষ্প হয়ে ওপরে ওঠে। এভাবে কয়েকবার এ বাষ্পকণাগুলো ওঠানামা করতে করতে এগুলো বৈদ্যুতিক আয়ন কণায় পরিণত হয়। আর এ কণাগুলোই বিপুল শক্তির বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। তবে আয়ন কণায় পরিণত হওয়ার পর এগুলো স্বাভাবিকভাবেই মেঘের ওপর ভাসে। কিন্তু যখন ভূপৃষ্ঠের আয়ন ধারণের ক্ষমতার কারণে এগুলো আবার মাটির দিকে চলে আসে। আর এ আয়ন কণাগুলো মেঘের ভেতর দিয়ে বজ্রের আকারে নিচে নেমে আসে। এ গবেষকের আশঙ্কা অদূর ভবিষ্যতে বজ্রপাত বাড়বে। কারণ হিসেবে তিনি বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে দায়ী করেছেন।