যদি কীছু মনে না করেন, একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি। উদ্ধৃতিটি একজন প্রবীণ ও বিখ্যাত রাজনীতিবিদের। বলা যায় তিনি দেশের অর্ধেক জনসংখ্যার রাজনীতিক প্রতিনিধি কিংবা কণ্ঠস্বর, যদিও তিনি ক্ষমতার বাইরে আছেন এবং প্রতিনিয়ত এমনসব কথা বলছেন যে, কোনও কোনও মহলের অভিজ্ঞ কেউ কেউ জনান্তিকে তাঁকে বাংলাদেশি (বাঙালি নয় কিন্তু) গুয়েবলস বলে অভিহিত করেন। কিন্তু মাঝে মাঝে বিশ্লেষণযোগ্য কথাও তিনি বলে থাকেন। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু এ দেশের মানুষের পকেটের টাকা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। সমস্যাটা কোথায়? যেটা করতে লাগত ১০ হাজার কোটি টাকা সেটা তৈরি করা হচ্ছে এখন ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে।’ কিন্তু আমাদের কথা হলো, যদি সেতুটি তৈরি করা না হতো তবে এই ৪০ হাজার কোটি টাকা কোথায় যেতো? সেই যাকে বলে পুঁজিবাদী রীতিপদ্ধতিতে ধনীদের পকেটে হয়ে বিদেশে পাচার হতো। পদ্মাসেতু হতো না, প্রকারান্তরে সাম্রাজ্যবাদের দালালির মাত্রা এককাঠি বাড়তো। দেশে এমন কাজ অনেক হয়েছে, নির্মাণ-বরাদ্দের টাকা থেকে প্রশাসনে বসে থাকা ঘুষখোর ও রাজনীতিক সন্ত্রাসী মস্তানদের দিয়ে থুয়ে ঠিকাদারের পকেটে ঢোকার কোনও টাকা থাকবে কি নির্মাণকাজের টাকাই থাকে না, ঠিকাদার শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে যে কাজটা করেন তার আয়ু দু-এক দিনের বেশি হয় না এবং এইরূপ অপচয়সম্পন্ন কাজের কোনও জবাবদিহিতা নেই দেশে এবং সেটা অপ্রতিহতভাবে প্রতিনিয়ত হচ্ছে দেশের সর্বত্র। যতো টাকাই লাগুক আমাদের সান্ত¦না এই যে, পদ্মাসেতুটি বোধ করি অচিরেই ভেঙে পড়বে না এবং সেটা কেউ পকেটে পুরে বিদেশে পাচার করতে পারবেন না, এটি দেশের মানুষের কাজে লাগবে। এই দেশের অর্থনীতির নীতি এই যে, যে-কোনও অবকাঠামোই এখানে তৈরি করা হোক না কেন অধিপতশ্রেণির লুটেরা সন্ত্রাসীরা সে-টা থেকে মুনাফা নয় বরং একটা নির্দিষ্ট অংশ আত্মসাৎ করবেনই, তা না হলে কোনও কাজই তারা দেশের ভেতরে কাউকেই করতে দেবেন না। পাড়ায় কেউ চাকরি করে জমানো টাকায় বাড়ি বানাচ্ছেন, সেখানেও মস্তানরা এই চাকুরের সারা জীবনের সততার একপয়সা দাম দেবেন না, নির্দিষ্ট হিস্যার টাকা না দিলে বাড়ি বানানো যাবে না, সেটাই সই এবং অন্যদিকে এবংবিধ ব্যাপারে প্রশাসন সাক্ষীগোপালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পছন্দ করেন, তাঁরাও তো এই লুটেরা অর্থনীতির বাইরের কেউ নন, যেমন বাইরের নন যে-কোনও রাজনীতিক দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের কেউ। প্রতিষ্ঠিত লুটপাটের অর্থনীতি ও সেটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের হাজারটা উদাহরণ দেওয়া যাবে। প্রকৃতপ্রস্তাবে বাস্তবতা হলো লুটপাট সম্পন্ন করার স্বার্থেই রাজনীতিক ক্ষমতায়নকে সে-মাপধাঁচের করে নেওয়া হয়েছে এবং এখানে সমাজতন্ত্র করার উদ্যোগ নেওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে।
যতদিন পুঁজিবাদী অর্থনীতি থাকবে ততদিন লুটপাট চলতেই থাকবে এবং এভাবেই পুঁজিবাদী অর্থনীতি চলে, সোজা কথায় লুটপাট বন্ধ হয়ে গেলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির মৃত্যু ঘটে, এটাই পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রাণভোমরা। তিন-চার গুণ বেশি খরচে কেবল পদ্মাসেতু নয়, সকল কাজই হবে অতিরিক্ত খরচের অর্থাৎ মুনাফা অর্জনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পর। পুঁজিবাদের নিয়ম এটাই, যাকে বলে লুটপাট। পুঁজিবাদী আর্থব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে রাজনীতি করে পুঁজিবাদের মুনাফার বিরুদ্ধে কথা বলা মানায় না, সেটা হয় একধরণের ভাওতাবাজি, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা। এই ভাওতাবাজি ছাড়তে হবে।
পরিশেষে তেমন কীছু বলতে চাই না, কেবল বলি, শোষণের রাজনীতি ছেড়ে শোষণহীন রাজনীতির চর্চা করুন এবং পদ্মাসেতু নির্মাণে বেশি টাকা খরচ হয়েছে সে কথা বলুন, তখনই কেবল কথা বলাটা জনগণের কাছে তাৎপর্য লাভ করবে অন্যথায় নয়। কারণ বর্তমান লুটেরা অর্থনীতির অধীনে আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিলে এর বেশি কীছু আপনিও তো করতে পারবেন বলে মনে হয় না। শেখ হাসিনা অন্তত পদ্মাসেতুটা জনগণের পাতে তোলে দিতে পেরেছেন, এই সত্যটা ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে।