গত বৃহস্পতিবারের (২৬ মে ২০২২ খ্রি.) দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি উদ্ধৃত সংবাদপ্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘অর্থনৈতিক মুক্তিই জাতির প্রধান চাওয়া – অর্থমন্ত্রী’। ক্ষমতাসীন দলের কিংবা ক্ষমতার বাইরে থাকা বিখ্যাত রাজনীতিবিদদের মধ্যে এই কথাটি মুখে উচ্চারণ করেছেন কে কে, তার একটি তালিকা করলে বোধ করি ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত সকল রাজনীতিবিদদের নামই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, দু’একজন বাদে কারও নাম বাদ দেওয়া যাবে না। অথচ আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বাস্তবে কিংবা কার্যত অর্থাৎ দেশের অর্থনীতিকে জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থের অনুকূলে বইয়ে বা বদলে দিতে আজ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন কোনও রাজনীতিক দলের পক্ষ থেকেই কোনও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় নি। কেন করা হয় নি, সেটা আপাতত এখানে কহতব্য নয়।
ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু তনয়ার পক্ষ থেক জনকল্যাণমূলক যে-সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তাদের প্রত্যেকটিকে সুবিধাভোগী চক্রের অবাধ মুনাফার ক্ষেত্র করে তোলা হয়েছে কিংবা সেটা কার্যত লুটপাটের অনুষঙ্গ ভিন্ন অন্য কীছু হয়ে উঠে নি। একটি গল্প আছে, বঙ্গবন্ধু একবার এক কৃষককে সবজির দাম দিয়েছিলেন ২০ টাকা। সেটা দু’তলা থেকে একতলায় গিয়ে হয়ে পড়েছিল ১০ টাকা। দেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এমনটাই চলছে। গত কয়েক দিন আগে সুনামগঞ্জের
সাংস্কৃতিককর্মীরা মানববন্ধন করে অভিযোগ করেছেন, সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ত নয় এমনসব সংগঠন এখানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ পাচ্ছে, আর যারা সত্যিকার অর্থে সাংস্কৃতিক কর্মকা- চালাচ্ছেন তাঁরা বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ দেশের কৃষকবান্ধব সরকার কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে প্রতি বছর সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকেন, কিন্তু তা কার্যত ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের মুনাফা শিকারের উত্তম ক্ষেত্র হয়ে উঠে। যাঁরা প্রতিনিয়ত বলেন, ‘অর্থনৈতিক মুক্তিই জাতির প্রধান চাওয়া’, তাঁরা সেটা ঠেকাতে পারেন না, বরং ফড়িয়াদের পক্ষাবলম্বন করার প্রবণতা তাঁদের মধ্যেই বেশি লক্ষ করা যায়। তাঁরা হাওররক্ষাবাঁধ ভাঙার দায় বন্যার উপরে নয় বরং কাঁকড়া ও ইঁদুরের উপর চাপিয়ে দিয়ে প্রকারান্তরে কৃষকের উপর কাঠামোগত সহিংসতা পরিচালনার পদ্ধতিটিকে আরও শক্তিশালী করে তোলেন।
‘ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি। সে প্রতিশ্রুতির উল্লেখ করে প্রতিবেদনটির এক জায়গায় অর্থমন্ত্রীর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘এই কাজটি করতে পারলে জাতির পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মূল জায়গায় স্পর্শ করতে পারবো। জাতির প্রধান চাওয়া ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি। জাতির পিতা আমাদের ভৌগোলিক মুক্তি দিয়ে গেছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তির কাজ তিনি সম্পন্ন করতে পারেন নি।’ এমন কথার পর অনেক কথাই বলার থাকে, কিন্তু কেবল একটি কথা বলি। ভুলে গেলে চলবে না, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মূল জায়গায় স্পর্শ করতে পারবো’টা কতটা কঠিন তা জাতির পিতা পরিজনসজহ নিজের জীবন উৎসর্গ করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, মন্ত্রীও সে মর্মান্তিক প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে। কঠিন এজন্য যে, বর্তমানে দেশ বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত আর্থনীতিক নীতি অনুসরণ করছে না, এখানে উন্নয়নের ফাঁকে ধনবৈষম্য নিরন্তর বাড়ছে, পুঁজিপতির সংখ্যা বাড়ছে অব্যাহতভাবে। বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত আর্থনীতিক নীতির সারার্থ পরিলক্ষিত হয় যখন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র এক জায়গায় জাতির পিতা বলেন, ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হবে না।’ এই নীতিটি অনুসরণ করতে না পারলে ‘অর্থনৈতিক মুক্তিই জাতির প্রধান চাওয়া’র প্রতিশ্রুতিটি কেবল কথার কথাই থেকে যাবে, চিরদিনের জন্যে।