বাদল কৃষ্ণ দাস ::
চলতি মার্চের বর্ধিত সময় পেরিয়ে গেলেও জামালগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাওরে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ এখনও পূর্ণতা পায়নি।
সম্প্রতি কিছু সংবাদপত্রে রহস্যজনকভাবে “বাঁধের কাজ সমাপ্ত এবং কৃষকের স্বস্তি” এরকম সংবাদ প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাওয়ায় হাওর বাঁচাও আন্দোলন কমিটির নেতৃবৃন্দ বিস্ময় প্রকাশ করেন। বৃহস্পতিবার হাওর বাঁচাও আন্দোলন কমিটি এবং সংবাদকর্মীদের সমন্বিত একটি টিম জামালগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি হাওরে বিভিন্ন বাঁধ প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে ব্যাপক অনিয়ম দেখতে পান। অযত্নে-অবহেলায় কৃষকের লালিত স্বপ্নকে উপহাস করছে বাঁধে বাঁধে সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম আর দায়হীন কর্মকাণ্ড। কোথাও আধাফুট, কোথাও এক থেকে দেড়ফুট, কোথাও পুরাতন বাঁধের উপরিভাগ কেবলই ছিলাচাছা করেই প্রত্যেকটি বাঁধের উপরের অংশ ঢেকে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বাঁধে মাটি ফেলার পর নিয়মমাফিক দুরমুজ করা হয়নি। বিপজ্জনক ক্লোজারগুলোতে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি লক্ষ করা গেছে। বাঁধের উপরে ও দু’পাশে ঘাস লাগানো এবং এসবের পরিচর্যা করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রকল্পের স্থানে স্থানে পিআইসির কাউকে দেখা যায়নি। কিছু কিছু বাঁধে দায়সারাভাবে ঘাস লাগানোর প্রচেষ্টা দেখা গেলেও সমুদয় ঘাস মরে আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। অনেকাংশেই যত্রতত্র পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে প্রকল্পের ছিঁড়াফাঁড়া, ভাঙাচোরা সাইনবোর্ড। এ যেন দায়হীন দায়িত্ব পালনের খেয়ালিপনা।
এবছর জামালগঞ্জ উপজেলার হাওরগুলোতে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে ৩৬টি প্রকল্পের কাজ হাতে নেয় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সকল বাঁধের কাজ স¤পন্ন করার সময় বেঁধে দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নির্ধারিত সময়ে শতভাগ কাজ স¤পন্ন না হওয়ায় পিআইসিকে ১০ মার্চ পর্যন্ত সময় বর্ধিত করে দেওয়া হয়। কিন্তু বর্ধিত সময় পেরিয়ে গেলেও অধিকাংশ বাঁধের কাজ নীতিমালা অনুযায়ী সম্পন্ন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট পিআইসিরা।
বেহেলী ইউনিয়নে বৌলাই নদীর দু’পাশের বাঁধগুলোতে এরকমই দৃশ্য দেখা যায়। বিস্তীর্ণ হালির হাওরের ফসল রক্ষায় স্থানীয় বদরপুর গ্রাম থেকে হাওরিয়া আলীপুর অভিমুখী ২০নং পিআইসির বেহালদশা দেখা গেছে। বৌলাই নদীর তীর ঘেঁষে এই প্রকল্পে ঘইন্যারখাড়া নামক স্থানে নতুন একটি ক্লোজার বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। এটি নদীর তলদেশ অবধি খাড়া অবস্থায় থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে ভাঙনের আশঙ্কা রয়েছে। এই ক্লোজারটিতে এখনও কাজ স¤পন্ন হয়নি। শ্রমিকরা এখনও খাড়া স্লোভে কাজ করছেন। বাঁধের গোড়া থেকেই বস্তায় বস্তায় মাটি ভরছে ক্লোজারটি বাঁধার জন্য। তাছাড়া এই প্রকল্পের অনেকাংশ উপরিভাগ কেবল ছিলাচাছা করে দু’পাশে মরা ঘাসে ঢেকে দিয়েছে পিআইসির লোকেরা।
১৯নং পিআইসির প্রকল্পের অনেকাংশ জুড়েই বাঁধে ফাটল ধরেছ, যা ভারী বর্ষণে নিশ্চিহ্ন হবার পর্যায়ে রয়েছে। এই প্রকল্পের মাহমুদপুর ক্লোজারটি গত বছরের পুরাতন বাঁশখোঁটার আঁড় দিয়েই চালিয়ে দিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। এই ক্লোজারটির সর্বত্রই ফাটল দেখা গেছে। ভারী বৃষ্টিপাত হলেই বাঁধের দু’পাশ ধ্বসে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।
১৬নং পিআইসির বাঁধের অবস্থাও অসমাপ্ত রয়ে গেছে। সেখানে বাঁধের দুপাশের মাটি এলোপাথাড়ি ছড়িয়ে পড়ছে। দুরমুজ করে ঘাস লাগানোর কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
১৭নং পিআইসির প্রকল্পের একই দশা। অপরদিকে ৫নং এবং ৬নং পিআইসির প্রকল্পে পুরাতন বাঁধের উপরিভাগ ছিলাচাছা করেই অল্প মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে পুরো বাঁধের কাঠামো। ৬নং পিআইসির ক্লোজারটির কাজ এখনও সমাপ্ত হয়নি। কর্মরত শ্রমিকরা বলেছেন, আরো কয়েকদিন লাগবে।
বৃহস্পতিবার জামালগঞ্জে স্থানীয় হালির হাওর এবং মহালিয়া হাওরে বৌলাই নদীর তীরবর্তী এসব বাঁধের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আসেন হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ স¤পাদক বিজন সেন রায়, সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি ইয়াকুব বখত, হাওর বাঁচাও আন্দোলনের জামালগঞ্জ উপজেলা কমিটির সভাপতি শাহানা আল আজাদসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এই টিমে সংবাদকর্মীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাদল কৃষ্ণ দাস, সাইফ উল্লাহ, আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি ইয়াকুব বখত বলেন, আজ যতগুলো বাঁধের পরিস্থিতি দেখেছি, তা খুবই উদ্বেগজনক। একশ্রেণির সংবাদকর্মীরা অতিউৎসাহী হয়ে পত্রিকান্তরে প্রচার করেছে বাঁধের কাজ সমাপ্ত এবং কৃষক স্বস্তি পেয়েছে। এটা নির্জলা মিথ্যা প্রচারণা। বাস্তবে বাঁধের কাজ সঠিকভাবে তো হচ্ছেই না, বরং অজানা কারণে কতিপয় সংবাদকর্মী তোষামোদী করে কাকে খুশি করতে কৃষকের ভাগ্য নিয়ে অতিরঞ্জিত বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেবার আহ্বান জানান।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ স¤পাদক বিজন সেন রায় বলেন, কিছু পত্রিকায় হাওর বাঁধের কাজ স¤পন্ন হয়ে গেছে এবং কৃষক স্বস্তি পেয়েছে বলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যে বানোয়াট সংবাদ ছেপেছে, আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। চিরাচরিত আবহাওয়ার অবনতি হবার আগেই দ্রুত হাওরের ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারসহ সকল বাঁধসমূহের নড়বড়ে অবস্থা দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়ে তিনি এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, এবার হাওরডুবি হলে এর দায় সংশ্লিষ্টদের উপরই বর্তাবে এবং হাওর বাঁচাও আন্দোলন অনিয়মকারী-দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।