বিশেষ প্রতিনিধি ও জয়ন্ত সেন ::
সুদে ঋণ এনে ও জমি বিক্রির ১৪ লাখ টাকায় দালালের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করে শাল্লা উপজেলার আনন্দপুর গ্রামের আশুতোষ রায় তার পুত্র আকাশ রায় (২৫) কে ইউরোপের দেশ গ্রীসের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন। দালাল চক্র দুবাই ও তুরস্ক হয়ে ধাপে ধাপে তাকেসহ স্বপ্নের দেশে পাড়ি দেওয়া অন্য যুবকদের নিয়ে ভূমধ্যসাগর হয়ে গ্রীসের কাছাকাছি চলেও এসেছিল। স্বপ্নের দেশ গ্রীস থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে তুরস্কের ইপসালা জেলার পাসাকই গ্রামের পাশে উপকূলের কাছে গ্রীস সীমান্তরক্ষীদের পুশব্যাকে পড়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মারা যান আকাশ। স্বপ্নের দেশের দ্বারের কাছে গিয়ে নিভে গেল তার জীবনপ্রদীপ। গত ২ ফেব্রুয়ারি তার লাশ উদ্ধার করে তুরস্কের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। ১০ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে নিজের ছেলে মারা গেছে এমন ছবি দেখে নির্বাক হয়ে গেছেন মা আরতি রাণী রায় ও বাবা আশুতোষ রায়সহ স্বজনরা। মা আরতি রায় বাড়ির পাশে মাঠে বসে অঝোরে কাঁদছেন আর ছেলের মরদেহের অপেক্ষা করছেন। মায়ের কান্না কিছুতেই থামছে না। আনন্দপুরের আকাশে এখন নিরানন্দের মেঘের দখলে।
আকাশ রায়ের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশুতোষ রায় ও আরতি রাণী রায় দম্পতির চার সন্তানের তৃতীয় আকাশ রায়। পারিবারিক টানাপোড়েনের কারণে সে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর পরিবারকে সহযোগিতা করতে দোকানে কাজ নেয়। গত কয়েক বছর ধরে দিরাই পৌর শহরের রায় মেশিনারিতে কাজ করতো আকাশ রায়। এসময় তার সঙ্গে টুকদিরাই গ্রামের এনামুল হকের পরিচয় হয়। এনামুল হক তাকে প্রস্তাব দেয় ১৪ লক্ষ টাকা দিলে তাকে সহজেই গ্রীসে পাঠিয়ে দিতে পারবে। বদলে যাবে তার জীবন। তার চোখে তখন রঙিন স্বপ্ন জীবন্ত হয়ে ওঠে। তরুণ আকাশ দালালের কথা বিশ্বাস করে বাড়িতে এসে গো ধরে স্বপ্নের দেশ ইউরোপে গিয়ে পরিবারের অভাব দূর করবে। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করায় বাবা-মাসহ স্বজনদের। গবাদি পশু বিক্রি করে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বাবার সঞ্চয়ের কিছু টাকা, জমি বিক্রিসহ নানাভাবে ১৪ লক্ষ টাকা তুলে দেন দালালের হাতে।
গত ২ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে বের হন আকাশ। প্রথমে তাদেরকে দুবাই নেওয়া হয়। দুবাই থেকে গ্রীস যাবার উদ্দেশ্যে তুরস্কে আনা হয় তাদেরকে। তুরস্ক থেকে ভূমধ্যসাগরে নামে তাদের বহনকারী বোট। তখন তীব্র ঠাণ্ডা। ৩১ জানুয়ারি সর্বশেষ কথা হয় মা ও বাবার সঙ্গে। তুরস্ক থেকে গ্রীসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার কথা জানিয়ে প্রার্থনা করার আহ্বান জানায় আকাশ রায়। ২ ফেব্রুয়ারি আকাশসহ কয়েকজন ঠাণ্ডায় ভূমধ্যসাগরে মারা যায়। স্বজনরা জানান, গ্রীসের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর পুশব্যাকের মুখে পড়ে সাগরে ঠাণ্ডায় জমে যান আকাশসহ অন্যরা। এক সময় মারা যান তারা। তবে মৃতের খবর জানতেন না পরিবারের লোকজন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে স্বজনরা তার মৃতদেহের ছবি দেখতে পান।
আকাশ রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিমেল সরকার বলেন, জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে দুবাই থেকে আমাকে ফোন দিয়েছিল আকাশ। বলেছিল একটি ছোট বোটে তারা ৯ জন রয়েছে। এর মধ্যে ৬ জন দিরাই-শাল্লার। ২৩ জানুয়ারি ফোন করে জানায় তুর্কি পৌঁছে গেছে। কয়েকদিনের মধ্যে সাগরপথে গ্রীসে পাড়ি জমাবে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি শুনলাম তার স্বপ্নের দেশ গ্রীস থেকে মাত্র ১০ কি.মি. দূরে তুর্কি উপকূল থেকে তাকেসহ মৃতদের উদ্ধার করেছে। দালালের খপ্পরে পড়ে একটি পরিবার এখন নিঃস্ব হয়ে গেছে।
আকাশ রায়ের বোন জামাই নীলেন্দু রায় বলেন, আকাশ পরিবারের অভাব ঘুচাতে ইউরোপের দেশ গ্রীসের জন্য দালালকে ১৪ লক্ষ টাকা দিয়েছিলাম আমরা। এখন টাকাও গেল, মানুষও গেল। আমার শ্বশুর শাশুড়ি আকাশের জন্য কাঁদতে কাঁদতে নির্বাক হয়ে গেছেন। তারা মৃত ছেলেকে শেষবারের মতো দেখতে চান। আকাশের মৃত দেহে দেখতে মা বাড়ির সামনে মাঠে অপেক্ষা করছেন। স্বজনদের কোন সান্ত¦না তিনি মানছেন না।
অভিযুক্ত এনামুল হকের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তিনি ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে লোক পাঠানোর কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে।
হবিবপুর ইউপি চেয়ারম্যান সুবল চন্দ্র দাস বলেন, আমার ইউনিয়নের আনন্দপুর গ্রামের আকাশ রায় তুর্কিতে সাগরে ঠাণ্ডায় মারা গেছে বলে আমরা জেনেছি। তার পরিবার ছেলেকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছে। এখন ছেলের মৃতদেহের অপেক্ষা করছেন তারা। তিনি বলেন, আমি প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানাই দালালকে ধরে আইনের আওতায় আনা হোক। পরিবারকে ক্ষতি পূরণ দেওয়া হোক।