সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎপরতা শুরু করেছে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী। কোনো রাজনৈতিক জোটে না গিয়ে আলাদাভাবে নির্বাচন করতে চাচ্ছে দলটি। এই নিয়ে দলটির নীতিনির্ধারকরা বৈঠক করছেন। ৬৪ জেলায় ‘গোপন কমিটিও’ গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির মাধ্যমে নেতাকর্মীদের সক্রিয় করতে বলা হয়েছে কেন্দ্র থেকে। গত শুক্রবার ধানমণ্ডি ও মোহাম্মদপুরের দুটি বাসায় জামায়াতের নারী শাখার বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে আগামী নির্বাচন নিয়ে বিশদ আলোচনা হয় বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।
তাছাড়া সম্প্রতি পুলিশের একটি প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, জামায়াত নির্বাচনকেন্দ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে না গেলে সামনের দিনগুলোতে সমস্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জামায়াত ও ছাত্রশিবিরসহ দলটির অঙ্গসংগঠনগুলোকে নজরদারির আওতায় আনতে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সবকটি রেঞ্জ অফিস, পুলিশ সুপার ও ইউনিট প্রধানদের কাছে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। গত রবিবার পাবনা জেলা জামায়াতের আমিরসহ দলটির শীর্ষস্থানীয় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড ও নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জামায়াতের নেতাকর্মীরা গোপন বৈঠক করছে বলে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে। দলটি দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত আছে। সংসদ নির্বাচন নিয়ে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। দলের নেতাকর্মীরা দেশের বিভিন্নস্থানে ঘাপটি মেরে আছে। তাদের প্রতিরোধ করতে সরকারের হাইকমান্ড থেকে নির্দেশনা এসেছে। পুলিশসহ অন্য সংস্থাগুলো সেইভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
ডিবি’র যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, জামায়াত ও ছাত্রশিবির ঢাকাসহ সারাদেশেই নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। মাস দুয়েক আগে রাজধানীর বারিধারা এলাকা থেকে জামায়াতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, জামায়াতের নেতাকর্মী যারা বিদেশে আছেন তারা নানা অপপ্রচার চালিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তারা সক্রিয়। তাদের প্রতিরোধ করতে যা যা করা দরকার তাই করা হবে। দেশের শান্তি বিনষ্ট করলে কঠোরভাবে দমন করা হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ২০১৩ সালে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করার আদেশ দেয় হাইকোর্ট। ২০১৮ সালে এটি গেজেট আকারে প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। বিগত নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ দলটি ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে। কিন্তু বর্তমানে টানাপড়েনের কারণে নিজস্ব ধারার রাজনীতিতে আসার চেষ্টা করছে দলটি। আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে জামায়াত। চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও দলের নেতারা স্বতন্ত্রভাবে অংশ নিয়েছেন।
সূত্র জানায়, জেলার গোপন কমিটির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে পুলিশ। নেতাদের তালিকাসহ পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠিয়েছেন জেলার এসপিরা। পরে তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণায়ের মাধ্যমে সরকারের হাইকমান্ডের কাছে পাঠানো হয়। তাছাড়া পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট মাস দুয়েক আগে ঢাকাসহ সারা দেশে জামায়াতের কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটি সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যনুযায়ী জামায়াত যেসব জেলায় গোপন কমিটি করেছে সেসব কমিটির মধ্যে নীলফামারীতে ১৩, চট্টগ্রাম ৩২, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ১৮, ফেনী ১২, লক্ষ্মীপুর ১৯, কুমিল্লায় ২২, চাঁদপুর ১১, কক্সবাজার ২৮, নোয়াখালী ২২, মানিকগঞ্জে ২০, ময়মনসিংহ ২২, নারায়ণগঞ্জে ১৭, নেত্রকোনায় ১৬, শেরপুর ১৪, জামালপুর ১৭, টাঙ্গাইল ২৮, নওগাঁয় ৭, পাবনায় ২৩, সিরাজগঞ্জ ১৩, বগুড়া ১২, রাজশাহী ১৮, নাটোর ১৪, জয়পুরহাট ১৩, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ২২, খুলনায় ১৮, যশোর ২৮, ঝিনাইদহ ১৯, নড়াইল ৯, কুষ্টিয়ায় ৩০, সাতক্ষীরায় ১৯, বাগেরহাট ১৪, রংপুর ১৭, কুড়িগ্রাম ১৫, গাইবান্ধায় ২২, দিনাজপুরে ১৯, ঠাকুরগাঁও ১৭, লালমনিরহাট ১৩, গাজীপুর ২১, নরসিংদী ৩১, ফরিদপুরে ২১, বরিশাল ১৫, ঝালকাঠি ১৭, পিরোজপুরে ১২, পটুয়াখালী ১৬, ভোলায় ১৯, সিলেট ২৫, মৌলভীবাজার ২৩, হবিগঞ্জে ৯ ও সুনামগঞ্জে ২৫ জনের নাম রয়েছে। কমিটির নেতাদের নামে দেশের বিভিন্ন থানায় নাশকতাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। জামায়াতের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে পুলিশের বিশেষ ইউনিটটি।
এই বিষয়ে কয়েকটি জেলার এসপি বলেন, জামায়াত পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের বৈঠক করার বিষয়ে পুলিশ নিয়মিত তথ্য পাচ্ছে। তবে ওইসব আস্তানায় অভিযান চালালে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। জামায়াতের তৎপরতা ঠেকাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের ওই কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেই জামায়াত তৎপর হয়ে উঠেছে ও প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে তারা মনে করেন। তারা নতুন কৌশলে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। পুলিশও এখন কৌশল বদলে তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াতের এক নেতা বলেন, আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই গত সপ্তাহে মহিলা জামায়াত সদস্যদের নিয়ে ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরে বৈঠক করা হয়। বৈঠকে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতা অংশ নিয়েছিলেন। সামনের নির্বাচনগুলোতে জামায়াত আলাদাভাবে অংশ নেবে বলে বৈঠকে জানানো হয়েছে। বিশেষ করে সংসদ নির্বাচনে কারা কারা প্রার্থী হতে পারেন তাদের তালিকা করতে বলা হয়েছে। কীভাবে দলকে আরও সংগঠিত করা যায় তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে বৈঠকে।
প্রসঙ্গত, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা ও মীর কাশেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। – দেশ রূপান্তর