সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে তিনটি লবিস্ট প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে বলে সরকার সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে। এই তিনটি লবিস্ট প্রতিষ্ঠানের পেছনে বিএনপি কমবেশি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার খরচ করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে, বিএনপির খরচ করা এই অর্থের উৎস বৈধ কি না সে বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত একাধিক বাহিনী। এরই মধ্যে এই ইস্যুতে বিএনপির অর্থদাতারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে রয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির খরচ করা অর্থের উৎস বৈধ কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য ওয়াশিংটনকে চিঠি দিচ্ছে ঢাকা।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট প্রতিষ্ঠানের পেছনে খরচ করা বিএনপির অর্থের উৎস স¤পর্কে খোঁজ নিতে গত ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ পাঠিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। পরদিন ১৯ জানুয়ারি একই তথ্য-প্রমাণ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে পাঠিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।
নির্বাচন কমিশনের আইন অনুসারে, নিবন্ধিত প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে প্রতিবছর আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করতে হয়। সেখানে বিএনপির খরচ করা এই অর্থের তথ্য আছে কি না সে বিষয়ে জানতে চেয়েছেন প্রতিমন্ত্রী এবং বলেছেন যে, যদি বিএনপি এই অর্থের হিসাব নির্বাচন কমিশনকে না জানিয়ে থাকে, তবে কমিশন দেশের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে, এমন প্রত্যাশা প্রতিমন্ত্রীর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে আসছে বিএনপি-জামায়াত। এই জোট দেশের বিরুদ্ধে প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি করেছে। পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে তারা অগ্নিসন্ত্রাস ও জঙ্গি উত্থানসহ সবই করেছে। এসব কারণে যখন তারা জনগণের সমর্থন হারাচ্ছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ দিয়ে সরকারকে চাপে ফেলতে দেশের বিরুদ্ধে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে। আমরা এই অপকর্ম খোলাসা করে খুব শিগগির দেশবাসীর কাছে প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করব। এই বিষয়ে আমাদের লোকজন কাজ করছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, বিএনপি গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে যে অর্থ ব্যয় করেছে, তার উৎস স¤পর্কে সরকার তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপি-জামায়াতের লবিস্ট নিয়োগের তথ্য-প্রমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে পাঠিয়েছি। দেশের আইন অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নেবে। পাশাপাশি বিএনপির এই অর্থ খরচের উৎস বৈধ কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারকেও বলছি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত একটি বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, যারা লবিস্টদের পেছনে অর্থায়ন করেছে, তাদের এরই মধ্যে নজরদারিতে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদেশি আটটি লবিস্ট প্রতিষ্ঠানকেও শনাক্ত করা হয়েছে। যারা অর্থায়ন করেছেন তাদের কয়েকজনকে এরই মধ্যে নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। এই ইস্যুতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎপর।
সূত্র আরও জানিয়েছে, বিএনপির পক্ষে যারা এই কাজে অর্থ দিয়েছে তাদের অনেকেই এখন বিদেশে বসবাস করছেন। আরও কয়েকজন বাংলাদেশে আছেন, তাদের মনিটরিং করা হচ্ছে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, এখন পর্যন্ত আমার হাতে এই বিষয়ে আটটি তথ্য-প্রমাণ এসেছে। এই আটটির মধ্যে বিএনপির পেয়েছি ন্যূনতম তিনটি, সেখানে এই তিনটি ডকুমেন্টেই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, পুরানা পল্টন অফিসের ঠিকানা লেখা আছে, যার মধ্যে ৬৫৮৭ নম্বরের লবিস্ট নিয়োগের একটি চুক্তিপত্র, সেখানে স্বাক্ষর করেছেন আবদুস সাত্তার, এই চুক্তিপত্র সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে মে ২০২০ সাল পর্যন্ত, প্রতি মাসে ৩৫ হাজার ডলারে ব্লুস্টার স্ট্র্যাটেজি নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে এ চুক্তি করে বিএনপি। আরেকটি ৬৫৮৬ নম্বর চুক্তিপত্রের জন্য প্রতি মাসে বিএনপি ১৫ হাজার ডলার দিয়েছে। যে মেয়াদে এই চুক্তি করা হয়, পূর্ণ মেয়াদে তার পেছনে খরচ হয়েছে এক মিলিয়ন ডলার। আরেকটি ডকুমেন্ট আছে যা ২০১৭ সাল মেয়াদ পর্যন্ত, এখানে কোনো ব্যক্তির নাম নেই; কিন্তু বিএনপির একই অফিসের ঠিকানা দেওয়া আছে, এটির নম্বর ৩৪৯২, এতে প্রতি মাসে ৪০ হাজার থেকে এক লাখ ডলার (কাজের পরিধি বুঝে) খরচ হতো, আমাদের হিসাবে এখানে খরচ হয়েছে কমপক্ষে দুই দশমিক সাত মিলিয়ন ডলার। এই তিনটি চুক্তিতে বিএনপি খরচ করেছে প্রায় তিন দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে আরও চারটি চুক্তি করেছে জামায়াতে ইসলামী। তারা পিস অ্যান্ড জাস্টিস নামে সংগঠনের নাম দিয়ে ওইসব চুক্তি করেছে এবং সেখানে নিউইয়র্কের ঠিকানা দেওয়া আছে।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, লবিস্ট নিয়োগ নিয়ে যা হচ্ছে, এগুলো সবই রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ। এটাকে আমি কোনো আইনি লড়াই মনে করি না। একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে প্রতিদিন যে রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের খেলা খেলে, এটা তারই অংশ। কারণ লবিস্ট নিয়োগ করা আমেরিকান আইনে বৈধ। এটা সরকারও করে এবং অন্যরাও করে। আর বিএনপি তো বলেছে যে তারা বাংলাদেশ থেকে কোনো লবিস্ট নিয়োগ করেনি, ওটা বিদেশ থেকে করা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, বিদেশে কোনো রাজনৈতিক দলের শাখা থাকা আইনত বৈধ নয়।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, হ্যাঁ, এটা ঠিক। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো শাখা বিদেশে অফিসিয়ালি নেই। বিদেশে যত আওয়ামী লীগ-বিএনপি আছে, তাদের কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই, শুধুমাত্র পেপারস তৈরি করে তারা কাজ করে। বাংলাদেশের কোনো সরকারই আওয়ামী লীগ-বিএনপি বলে তাদের স্বীকৃতি দেয় না, শুধু তাদের সঙ্গে মিটিং করে।
বিএনপির বক্তব্য অনুযায়ী, বিদেশ থেকেই লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু ঠিকানায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া আছে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন এই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে কি না। জবাবে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাঠাতে হলে বৈধ প্রক্রিয়ায় পাঠাতে হবে। লিগ্যালি অর্থ না পাঠালে অপরাধ হবে। এক্ষেত্রে সব কিছু অর্থের সঙ্গে স¤পর্কিত, এর বাইরে এখানে আইনি কোনো ব্যত্যয় নাই। আর ঠিকানায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তথ্য উল্লেখ থাকতে পারে; কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। সরকার যদি প্রমাণ করতে পারে যে, বিএনপি দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ পাঠিয়েছে তবেই এটা অপরাধ হিসেবে আইনের কাছে বিবেচিত হবে।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, নির্বাচন কমিশন যা করতে পারবে, সেটা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনে যে হিসাবটা দেওয়া হয় এই হিসাবের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতা আছে যে, তারা দেখবে হিসাবটি সঠিক আছে কি না। তবে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো যে হিসাব দিয়েছে, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে কখনই নড়াচড়া করতে দেখিনি, কখনও কোনো অডিট বা এমন কিছু দেখিনি। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন যদি দেখে যে, তাদের কাছে যে হিসাব আছে, তার বাইরেও তাদের (বিএনপি) আয় বা ব্যয় আছে তবে নির্বাচন কমিশন সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে। এই ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের আছে। কিন্তু আগে প্রমাণ করতে হবে যে, বিএনপি দেশ থেকে অর্থ পাঠিয়েছে এবং সেই হিসাব কমিশনে দাখিল করেনি।
বিগত ১৯৮২ সালে দেশের চা শিল্পের উন্নতির জন্য সর্বপ্রথম যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করে ওই সময়ের সরকার। এরপর একাধিক সময়েই দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। কিন্তু এবারই প্রথমবারের মতো লবিস্ট নিয়োগের বিতর্ক জাতীয় সংসদ পর্যন্ত গড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতেই বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। লবিস্ট নিয়োগের এই অর্থ খরচের উৎস স¤পর্কে বিএনপিকে পাই পাই হিসাব দিতে হবে।’