বিশেষ প্রতিনিধি ::
২৬ জানুয়ারি রাতে ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর নির্বাক হয়ে গেছেন মা রহিমা খাতুন। স্বজনরা তাকে খাওয়াতে পারছেন না কিছু। ‘আমার ছেলেরে আইন্যা দেও’ (আমার ছেলেকে এনে দাও) ছাড়া আর কোন কথা বলছেন না। শুধু বিলাপ করছেন তিনি। প্রতিবেশীরা সান্ত¦না দিতে গিয়ে নিজেরাও কেঁদে কেটে ফিরছেন। এখন ছেলেহারা কঠিন মানসিকতা সম্পন্ন বাবা নূরুল আমিনও নির্বাক হয়ে আছেন। সরকারের কাছে তিনি দাবি জানিয়েছেন, মৃত ছেলেকে তার কাছে শেষবারের জন্য ফিরিয়ে দিতে। চোখের জলে শেষ বিদায় জানাতে চান তার প্রিয় সন্তানকে।
দালালের মাধ্যমে স্বপ্নের দেশ ইউরোপের ইতালিতে যাবার পথে গত ২৫ জানুয়ারি তীব্র ঠাণ্ডায় নৌকাতেই মারা যান জামালগঞ্জ উপজেলার ভিমখালি ইউনিয়নের ফেকুল মামুদপুর গ্রামের নূরুল আমিনের ছেলে সাজ্জাদ আহমেদ (২৪)। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে সাজ্জাদ আহমেদ নূরুল আমিন ও রহিমা খাতুন দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন।
সাজ্জাদ আহমেদের পরিবারের লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৩ ডিসেম্বর লালুখালি গ্রামের ফয়জুর রহমান ও শান্তিগঞ্জ উপজেলার ধনপুর গ্রামের রফিক মিয়ার মাধ্যমে ৮ লাখ টাকা চুক্তিতে ছেলেকে লিবিয়া হয়ে ইতালির উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন নূরুল আমিন। ফয়জুর রহমান ধনপুর গ্রামের রফিক মিয়ার মাধ্যমে দুবাই-লিবিয়া হয়ে তাকে সাগরপথে ইতালির উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন। তারা তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল ৮ লাখ টাকায় সহজেই তাকে পৌঁছে দেবে স্বপ্নের দেশে। হালের বলদ, মায়ের স্বর্ণ ও জমি বিক্রি করে তিনি দালালের হাতে তুলে দেন টাকা। গত ৩ ডিসেম্বর পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ছাড়েন ২৪ বছর বয়সী স্বপ্নবাজ যুবক সাজ্জাদ আহমেদ। গত ২২ জানুয়ারি রাতে বাবাকে ফোন করেন সাজ্জাদ। তার কথা অস্পষ্ট। কেঁপে কেঁপে কথা বলছিল ছেলে। বাবাকে জানায়, দালালের লোকজন টাকার জন্য তাকে নির্যাতন করছে। আর বেশি কথা বলতে পারেনি ছেলেটি। ফোন লাইন কেটে যায়। ছেলের ফোনের পরেই বুক ধড়ফড়ানি শুরু হয় বাবা নূরুল আমিনের। এরপরই লালুখালি গ্রামের ফয়জুর রহমানের কাছে ফোন দিয়ে ছেলের বিপদ ও জীবন সংকটের কথা জানান তিনি। পাত্তা দেননি ফয়জুর রহমান। ২৬ জানুয়ারি রাতেই তিনি প্রিয় ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে মুষড়ে পড়েন। এখন তার একমাত্র দাবি ছেলের মুখ শেষ বারের মতো স্ত্রীকে নিয়ে দেখতে চান। চোখের জলে বিদায় জানাতে চান প্রিয় সন্তানকে।
স্বজনরা জানান, ২৮০ জন অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে বোট ছেড়েছিল। তখন ভূমধ্যসাগরে খুব ঠাণ্ডা ছিল। ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে নৌকাতেই মারা যান সাজ্জাদ আহমেদসহ বাংলাদেশি ৭ যুবক। ইতালির কোস্ট গার্ডের সদস্যরা তাদেরকে উদ্ধারের পরই বিষয়টি জানাজানি হয়। পরিবারের লোকজন জানতে পারেন এই করুণ আখ্যান।
সাজ্জাদ আহমেদের পিতা নূরুল আমিন বলেন, দালাল ফয়জুর রহমান ও রফিক মিয়ার কথায় আশ্বস্ত হয়ে ৮ লাখ টাকা দিয়ে ইতালির উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলাম ছেলেকে। এখন শুনেছি ছেলে সাগরে অনেক কষ্ট পেয়ে মারা গেছে। এর আগে লিবিয়াতেও দালাল ফয়জুর রহমানের লোকজন আমার ছেলেকে টাকার জন্য মারধর করেছে। তারা বিভিন্ন সময়ে টাকার জন্য আমার ছেলের উপর নির্যাতন করেছে। আমি আমার মরা ছেলেকে শেষ দেখা দেখতে চাই। বিচার চাই দুই দালালের। তিনি বলেন, আমার ছেলের মতো যেন আর কোন বাবার বুক খালি না হয়।
ভিমখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, কিছুদিন আগেও ছেলেটি আমার নির্বাচনে কাজ করেছে। ইউরোপের স্বপ্নের হাতছানি নিয়ে সে বাড়ি ছেড়েছিল। এখন মর্মান্তিকভাবে সাগরে মারা গেছে। তার মা-বাবা প্রিয় সন্তানের মরা মুখটি দেখার প্রতীক্ষায় আছেন। আমরাও সরকারের কাছে দাবি জানাই যাতে অসহায় মা-বাবার শেষ ইচ্ছেটি পূরণ করা হয়।
অভিযুক্ত ফয়জুর রহমানের মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তাই তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জামালগঞ্জ থানার ওসি আবদুল নাসের বলেন, আমরাও মর্মান্তিক এই ঘটনাটি জেনেছি। পরিবারের সবাই এখন শোকে কাতর। পরিবারের পক্ষ থেকে দালালদের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
এদিকে, লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার পথে ঠাণ্ডায় প্রাণ হারানো জামালগঞ্জের সাজ্জাদ আহমেদসহ সাত বাংলাদেশির পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে। এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে ইতালির রোমে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস। দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, মারা যাওয়া সাতজন হলেন- ১. ইমরান হোসেন, গ্রাম: পশ্চিম পিয়ারপুর, উপজেলা: মাদারীপুর সদর, জেলা: মাদারীপুর। ২. জয় তালুকদার ওরফে রতন, গ্রাম: পিয়ারপুর, উপজেলা: মাদারীপুর সদর, জেলা: মাদারীপুর। ৩. সাফায়েত, গ্রাম: ঘটকচর, উপজেলা: মাদারীপুর সদর, জেলা: মাদারীপুর। ৪. জহিরুল, গ্রাম: মোস্তফাপুর, উপজেলা: মাদারীপুর সদর, জেলা: মাদারীপুর। ৫. বাপ্পী, উপজেলা: মাদারীপুর সদর, জেলা: মাদারীপুর। ৬. সাজ্জাদ, গ্রাম: মামুদপুর, উপজেলা: জামালগঞ্জ, জেলা: সুনামগঞ্জ। ৭. সাইফুল, উপজেলা: ভৈরব, জেলা: কিশোরগঞ্জ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২৫ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালির ল্যাম্পে পাদুসা দ্বীপে যাওয়ার পথে অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় ৭ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। ইতালি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে কোনো ধরনের শনাক্তকারী নথিও ছিল না। ফলে শনাক্তকরণে জটিলতা দেখা দেয়।
সাত বাংলাদেশির পরিচয় নিরূপণের জন্য উদ্ধার করা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন রোমের বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা। উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মারা যাওয়া সাতজনের পরিচয় পাওয়া যায়। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের লাশ সরকারি খরচে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া স¤পন্ন করতে এখন স্বজনদের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত হতে হবে বলে জানায় দূতাবাস।
মারা যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারকে দ্রুত নিকটস্থ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় বা ই-মেইলের মাধ্যমে রোমে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
জানাযায়, অবৈধভাবে নৌকাযোগে লিবিয়া থেকে ইতালির ল্যাম্পে পদুসা দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন একদল অভিবাসনপ্রত্যাশী। যাত্রাপথে ঠাণ্ডায় প্রাণ হারান সাতজন। ইতালির বাংলাদেশ দূতাবাস জানায়, ওই নৌকায় যাত্রী ছিলেন ২৮৭ জন, তাদের মধ্যে ২৭৩ জনই বাংলাদেশি।
ল্যা¤েপদুসা দ্বীপটি ইতালির মূল ভূখণ্ড থেকে যতটা না কাছে, তার চেয়ে বেশি কাছে আফ্রিকার দেশগুলোর। এতে আফ্রিকা হয়ে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশী পাঠানোর ক্ষেত্রে রুটটি ব্যবহার করেন মানবপাচারকারীরা।
ইউরোপে শীত বাড়ছে, এতে বৈরি হয়ে উঠছে আবহাওয়া। এ ছাড়া অভিবাসনপ্রত্যাশীরা যাতে ইউরোপে ঢুকতে না পারেন, সেই চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে এই অঞ্চলের দেশগুলো। এরপরও চলতি বছরের শুরু থেকে শত শত অভিবাসনপ্রত্যাশী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছেন।