সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
কভিডের কড়াকড়িতেও থেমে নেই সমুদ্রপথে অবৈধ অভিবাসনের প্রয়াস। মহামারী পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশী। অনেকে ধরাও পড়েছেন। জার্মানিভিত্তিক তথ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর ১১ মাসে (জানুয়ারি-নভেম্বর) সাগরপথে শুধু ইতালিতে প্রবেশের চেষ্টা চালাতে গিয়েই আটক হয়েছেন ৭ হাজার ৩৬ জন বাংলাদেশী।
সর্বশেষ ২৫ জানুয়ারি ইতালিতে অভিবাসন প্রত্যাশায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার পথে ধরা পড়েন ২৮৭ জন। এর মধ্যে ২৭৩ জনই বাংলাদেশী। যাদের মধ্যে আবার সাতজন বাংলাদেশী ঠাণ্ডাজনিত রোগে নৌকাতেই মারা গেছেন। তাদের মধ্যে জামালগঞ্জের একজন রয়েছেন। অসাধু মানব পাচারকারী চক্র তাদের ওই বিপদসংকুল পথে নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে রোমের বাংলাদেশ মিশন। ওই দুষ্ট চক্র থেকে সাবধান থাকতে দেশের তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রোমে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান।
রোমে বাংলাদেশ দূতাবাসের জারি করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২৫ জানুয়ারি সংঘটিত দুর্ঘটনার বিষয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য দূতাবাস ইতালির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। সাত বাংলাদেশীর মর্মান্তিক মৃত্যু-পরবর্তী কার্যক্রমে ইতালির বাংলাদেশ দূতাবাস সক্রিয় রয়েছে জানিয়ে প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৫ জানুয়ারি সংঘটিত মর্মান্তিক ঘটনায় দীর্ঘক্ষণ তীব্র ঠাণ্ডা থাকার ফলে হাইপোথার্মিয়ার কারণে সাত বাংলাদেশী নাগরিকের নিহত হওয়ার বিষয়ে অবগত হওয়ার পর থেকেই ইতালির বাংলাদেশ দূতাবাস সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ করে চলেছে। ইতালির কাতানিয়া ও পালের্মোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের অনারারি কনসালদের মাধ্যমেও বাংলাদেশ দূতাবাস প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধান এবং যথোপযুক্ত করণীয় নির্ধারণের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
গত বছর ২৪ জুন ভূমধ্যসাগর থেকে ভাসমান অবস্থায় ৩৬৭ জনকে উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে ৩৬৪ জনই বাংলাদেশী। ওই বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে একইভাবে ইতালিতে প্রবেশের চেষ্টা চালানোর সময় ১০ জুন ১৬৪ জন, ২৭ ও ২৮ মে ২৪৩ এবং ১৮ মে ৩৬ জন বাংলাদেশীকে উদ্ধার করা হয়। মে মাসে আলজেরিয়ার সীমান্তবর্তী মরুভূমি থেকে অপহরণকারীদের কবল থেকে ৮৬ বাংলাদেশীকে উদ্ধার করা হয়।
২১ জানুয়ারি রাতেও ইতালির লা¤েপদুসা দ্বীপ থেকে ৩০ মাইল দূরে ভূমধ্যসাগরে একটি অভিবাসীবাহী নৌকার খোঁজ পায় দেশটির কোস্টগার্ড। ছোট্ট একটি নৌকায় গাদাগাদি করে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিন শতাধিক অভিবাসনপ্রত্যাশী। উত্তাল সাগরে নৌকাটি ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি থাকায় তাদের উদ্ধার করে জাহাজে তুলে নেয় ইতালির কোস্টগার্ড। পরে তাদের লা¤েপদুসা দ্বীপে আশ্রয় দেয়া হয়। এদের মধ্যে ১৭ জন নারী ও ছয়টি শিশু রয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য বলছে, গত বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছেন ৬৭ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী। এদের মধ্যে শুধু ইতালিতেই আশ্রয় পেয়েছেন প্রায় ১৭ হাজার। বিপজ্জনক এ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ হাজারের বেশি। ইউএনএইচসিআরের তথ্য বলছে, ২০২০ সাল থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেড় বছরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে আটক হয়েছেন অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার বাংলাদেশী।
সাগরপথকে ধরা হয় অবৈধ অভিবাসনের সবচেয়ে বিপজ্জনক পথ হিসেবে। পদে পদে মৃত্যুভয়। সাগরপথে পাড়ি দেয়ার আগেই আন্তর্জাতিক অপহরণকারী চক্রের কবলে পড়ে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারানো, এমনকি মৃত্যুর আশঙ্কাও অনেক। আবার ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সাগর পাড়ি দিতে অভিবাসনেচ্ছুদের গাদাগাদি করে তুলে দেয়া হয় ছোট ছোট নৌকায়। প্রতিনিয়তই সাগরে এসব নৌকা উল্টে গিয়ে প্রচুর মানুষের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। আবার বিপজ্জনক এ পথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্য দেশে পৌঁছলেও রয়েছে ধরা পড়ে জেল-জরিমানার ভয়। যদিও এসবের কোনো কিছুরই ভয় থামাতে পারছে না ভয়ংকর এ যাত্রাকে। ইউরোপে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাগর পাড়ি দেয়ার আগে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে যেতে ভারত-শ্রীলংকা-লিবিয়া, দুবাই-জর্ডান-লিবিয়া ও দুবাই-তুরস্ক-লিবিয়া এ তিনটি রুটকে বেছে নেয় মানব পাচারকারীরা।
ব্র্যাকের গবেষণা তথ্য বলছে, ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী লোকজন সবচেয়ে বেশি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছেন। তাদের মধ্যে ৩১ থেকে ৩৫ বছরের লোকই বেশি। গত কয়েক বছরে ইউরোপ ও লিবিয়া থেকে ফেরত আসা ২ হাজার ২৮৪ বাংলাদেশীর সঙ্গে কথা বলেছে ব্র্যাক। সেখানে দেখা গেছে, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, ঢাকা, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা জেলা থেকে বেশি লোক এভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। একেকজন ইউরোপে যেতে ৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ করেছেন।
ইউরোপে প্রবেশের রুট হিসেবে বর্তমানে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে একাধিক মানব পাচারকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অনেকেই ওইসব দেশেও আটক হয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পাচারের শিকার ৩ হাজার ৭০০ জনকে দেশে ফেরত আনা হয়েছে।
সমুদ্রপথে অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়- স¤পর্কিত সংসদীয় কমিটিও। কমিটির গত জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকের আলোচনায় বলা হয়, অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মানব পাচারের ঘটনায় বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বৈঠকে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে বিদেশ গমন রোধকল্পে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়ে যৌথ কমিটি করে দায়ী সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলোর লাইসেন্স বাতিলের পাশাপাশি আইন অনুযায়ী যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার সুপারিশ উঠে আসে। একই বৈঠকে অবৈধ অভিবাসীদের দেশে ফেরত নিয়ে আসার পর রিমান্ডে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
স্ট্যাটিস্টা প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত বছর প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) সমুদ্রপথে অবৈধভাবে ইতালিতে প্রবেশ করে বাংলাদেশী পরিচয়ে আত্মসমর্পণ করে নিবন্ধিত হয়েছেন ২ হাজার ৬০৮ জন। এ সংখ্যা ছয় মাসে মোট আত্মসমর্পণকারীর ২১ শতাংশ। ইতালিতে ছয় মাসে আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে দ্বিতীয় তালিকায় রয়েছেন তিউনিসিয়ার নাগরিকরা। ২ হাজার ১১৩ জন তিউনিসিয়ার নাগরিক ইতালিতে প্রবেশ করেছেন, যা মোট সংখ্যার ১৪ শতাংশ। অভিবাসনপ্রত্যাশীর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে আইভরি কোস্ট। দেশটির মোট ১ হাজার ৪১০ নাগরিক ইতালিতে পৌঁছে নিবন্ধন করেছেন। এছাড়া ইরিত্রিয়া থেকে গিয়েছেন ৯৭১ জন, মিসর ৯৫৮, গিনির ৯৪৫, সুদানের ৯০৫, মরক্কোর ৬২৩, মালির ৫৬৮ ও আলজেরিয়া থেকে ৪৫৬ জন নাগরিক ইতালিতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন বছরের প্রথম ছয় মাসে।
জানা গেছে, সমুদ্রপথে অবৈধভাবে বিদেশ গমন ঠেকাতে গত ১৪ জুলাই লিবিয়া, তিউনিসিয়ায় উদ্ধারকৃত বাংলাদেশী নাগরিকদের প্রত্যাবাসন এবং ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ শিরোনামে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ছাড়াও ইতালি, লিবিয়া, স্পেন প্রভৃতি দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতরাও অংশগ্রহণ করেন। সভায় সমুদ্রপথে অবৈধ উপায়ে বিদেশযাত্রা রোধে বেশকিছু সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়। সেসবের মধ্যে রয়েছে দুবাই থেকে বেনগাজি পর্যন্ত বাংলাদেশী নাগরিকরা যাতে সহজে যেতে না পারেন সে ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, ট্রাভেল এজেন্টদের বিষয়ে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা এবং সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর আরো জোরালো ভূমিকা রাখা, বিদ্যমান আইনকানুন ও বিধিতে সময়োপযোগী পর্যাপ্ত বিধান সংযোজন করা, মানব পাচারে জড়িত অপরাধীদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, করোনাকালে অবৈধ পথে বিদেশগমনের প্রবণতা অনেকটাই বেড়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। খুব দ্রুতই একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এভাবে মানব পাচারের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ প্রবণতা বন্ধে পাচারকারী ও পাচার হওয়া ব্যক্তিদের দেশে এনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।