বিশেষ প্রতিনিধি ::
বর্ষা মওসুমে সুনামগঞ্জের হাওরের বিভিন্ন গ্রামে পানিতে ডুবে শিশু-কিশোরদের মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন হাওরাঞ্চলের মানুষজন। গত সাড়ে তিন মাসে অন্তত ১৩ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। কেউ হাওরের পানিতে ডুবে, কেউবা হাওরঘেরা বাড়ির পুকুরে ডুবে বাড়ির পাশের খাল-নদীতে ডুবে মারা যায়। তবে বর্ষা মওসুমেই মৃত্যুর হার বেশি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরও পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুহার বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করেছে।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষা মওসুমে হাওর পানিতে ফুলে ফেঁপে ওঠে। তখন বাড়ির আঙিনায়ও চলে আসে পানি। বাড়ির পাশের পুকুর, খাল ও নদী একাকার হয়ে যায় বর্ষার পানিতে। এসময় পরিবারের লোকদের অগোচরে শিশু-কিশোররা পানিতে নেমে মৃত্যু ডেকে আনছে। প্রতি বছর উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা। একমাত্র সন্তান হারিয়ে নির্বাক হয়ে যাচ্ছে পুরো পরিবার।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর দিরাই ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় তিন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। দিরাইয়ে কালনী নদীতে পড়ে মারা যায় উপজেলার করিমপুর গ্রামের হরিদাশ বিশ্বাসের ছেলে দ্বীপ বিশ্বাস (৫)। হরিদাশের একমাত্র ছেলে হারিয়ে এখনো বিলাপ করছেন তিনি। ওইদিন দোয়ারাবাজার উপজেলার জুমগাঁও ও চিলাইপাড় গ্রামে দুই শিশুও পুকুরে ডুবে মারা যায়। চিলাইপাড় গ্রামের ছফির উদ্দিনের পুকুরে ৫ বছরের শিশু আমেনা বেগম ও একই উপজেলার জুমগাঁও গ্রামের হায়দর আলীর ২০ মাস বয়সী শিশু পুত্র মিছবাউল আলম মারা যায়।
গত ৩ অক্টোবর দিরাই উপজেলায় বসত বাড়ির পাশে পুকুরে পানিতে ডুবে রিফাত মিয়া নামের ৭ বছর বয়সী এক শিশু মারা যায়। রিফাত মিয়া দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের পুরাতন কর্ণগাঁও গ্রামের ফারুক মিয়ার ছেলে। গত ৭ অক্টোবর দিরাই উপজেলার টুক দিরাই গ্রামে নানার বাড়িতে বেড়াতে এসে খালে ডুবে মারা গেছে ৯ বছরের শিশু কন্যা সুমাইয়া আক্তার। সুমাইয়া সিলেটের টুকের বাজারের জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে।
জামালগঞ্জে গত ২০ জুলাই বাড়ির পাশের হাওরে ডুবে মারা গেছে দুই বছরের নাছুফা বেগম। সে বেহেলি ইউনিয়নের হরিনাকান্দি গ্রামের ইকমবাল মিয়ার মেয়ে। গত ৫ আগস্ট শাল্লা উপজেলার ভেড়া মোহনা হাওরে ডুবে মারা গেছে দুই কিশোরী। তারা হলো চাঁদনি বেগম ও সাবিনা বেগম। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ধর্মপাশার বৈখজোড়া গ্রামে বাড়ির সামনের ডোবায় ডুবে মারা যায় তিন বছরের মেয়ে অরূপা আক্তার। অরূপা আমিরুল ইসলামের মেয়ে। একই উপজেলায় গত ২৯ জুলাই বাড়ির পাশের ডোবায় মারা যায় তিন বছরের শিশু কন্যা খাদিজা আক্তার।
গত ৭ সেপ্টেম্বর তাহিরপুরের নাগরপুর গ্রামে বাড়ির সামনের পুকুরে ডুবে আফরোজা আক্তার নামের এক শিশু মারা যায়। সে গ্রামের মো. শুক্কুর আলীর মেয়ে। গত ২২ জুলাই জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে ডোবার পানিতে ডুবে মারুফ আহমদ নামের ৭ বছরের এক শিশু মারা যায়। সে গ্রামের লিটন মিয়ার ছেলে। ৬ আগস্ট বিশ্বম্ভরপুরে মহসিন আবির নামের ৪ বছরের এক শিশু বাড়ির পাশে হাওরের ডোবায় ডুবে মারা গেছে। সে ললিয়াপুর গ্রামের মিজানুর রহমান মিজানের ছেলে।
গত ৮ আগস্ট ছাতকের কালারুকা গ্রামের আরিফ আলী নামে তিন বছরের এক শিশু মারা যায়। সে কালারুকা ইউনিয়নের কালারুকা গ্রামের আমিনুর রহমানের ছেলে। এছাড়াও গত ২৯ এপ্রিল তাহিরপুরে বৌলাই নদীতে ডুবে নাহিদুল ইসলাম নামের ৫ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সে গোবিন্দশ্রী গ্রামের মিস্টার নুরের ছেলে। গত ১৯ এপ্রিল একই উপজেলার মন্দিআতা গ্রামে বাড়ির পাশের হাওরে ডুবে তানজিমা আক্তার নামের এক বছরের এক শিশু মারা যায়। সে গ্রামের শাহিন মিয়ার মেয়ে।
জামালগঞ্জের বেহেলি ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মনেছা বেগম বলেন, প্রতি বছরই বর্ষা মওসুমে হাওরের বিভিন্ন গ্রামের শিশুরা মারা যায়। প্রতি বছরই এই সংখ্যা বাড়ছে। পারিবারিক সচেতনতা ছাড়া মৃত্যু থামানো সম্ভব নয়।
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, বর্ষায় হাওরের গ্রামগুলো দ্বীপের মতো দেখায়। পানি চলে আসে বাড়ির উঠোনে। পানি দেখে শিশুরা আহ্লাদিত হয়। তারা খেলতে চায়। এই সময় শিশুদের চোখে চোখে রাখতে হয়। তবে পারিবারিকভাবেই শিশুদের সাঁতার শিখানো গেলে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে জানান তিনি।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, বর্ষা মওসুমে হাওরের গ্রামগুলোর কোমলমতি অনেক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এসময় পরিবারের লোকদের সতর্ক থাকা উচিত। কারণ চারদিকে পানি দেখে শিশুরা খেলতে চায়। পরিবারের লোকদের অগোচরেই দুর্ঘটনা ঘটে। শিশুদের হারিয়ে পরিবারে শোকের মাতম ওঠে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, সুনামগঞ্জে প্রতি বছর গড়ে ৩০-৪০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। কেউ পুকুরে পড়ে, কেউ হাওরে বা খালে। আমরা মৃতদের তথ্য সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রেরণ করি। পরিবার গরিব হলে সরকারিভাবে কিছুটা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। তবে হাওরের শিশুদের সাঁতার শেখানোর সঙ্গে পারিবারিক সচেতনতাও বৃদ্ধি করাও প্রয়োজন।