বিশেষ প্রতিনিধি ::
সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তে জীবদ্দশায় তাঁর কুকুরের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বিস্কুট নিয়ে যেতেন- সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টর এনামুল কবির ইমনের দেওয়া এমন একটি ‘বিতর্কিত’ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইমনকে একহাত নিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী। এই বিবাদে জেলাজুড়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
রোববার বিকেলে দিরাইয়ে আয়োজিত এক শোকসভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় ব্যারিস্টার ইমনের বক্তব্য নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন মন্ত্রী। দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত আছাব উদ্দিন সরদার স্মরণে উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশ এই শোকসভার আয়োজন করে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, “কাজের সময় ঝগড়া-বিবাদ করা ভল নয়। কাজের সময় দরকার ঐক্যের। একজন নেতা সেদিন এখানে বলে গেছেন, আমি নাকি সেনবাবুর বাসার কুকুরের জন্য বিস্কুট নিয়ে যেতাম। কি একটা হাসির কথা! বাচ্চা ছেলে, বয়স কম। যদিও আমি কুকুরের জন্য বিস্কুট নিয়ে যেতাম, তবে মনে করি এই ধরনের মানুষের চেয়ে কুকুরকে বিস্কুট খাওয়ানো অনেক ভাল। কুকুরের তবুও মনমানসিকতা আছে। আমি জীবনেও সেনবাবুর বাসায় বিস্কুট নিয়ে যাইনি। তাই বলে কি আমি উনার বাসায় যেতে পারি না। অনেকবার আমি তাঁর বাসায় গিয়েছি। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন বড়ভাই হিসেবে, এলাকার নেতা হিসেবে। এগুলো খোটা দেওয়ার বিষয় নয়।”
মন্ত্রী আরও বলেন, “বাচ্চা ছেলেপেলে, নেতা হয়ে মাথা ঘুরে গেছে। এই মাথাঘুরা নেতা দিয়ে আমাদের উন্নয়ন হবে না। আমাদেরকে কাজ করতে গেলে ঘর পরিষ্কার কতে হবে। আর ঘর পরিষ্কার করতে গেলে রোজগারী রাজনীতিবিদদের, যারা টাকার সন্ধানে রাজনীতি করে, যারা বিল খায়, পাথর খায়, বন খায়, খাস জমি খায়, এদেরকে পরিষ্কার করতে হবে। এদেরকে সরাতে হবে। সাধারণ মানুষের যেগুলো প্রয়োজন সেই কাজগুলো আমাদের করতে হবে। সুযোগসন্ধানী, দালাল রাজনীতিবিদ যার দুটো পয়সা বানাবার জন্য রাজনীতিতে আসে এবং আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে তাদের সবখবর আমাদের নেত্রীর কাছে আছে। আমার কয় বিঘা জমি, ব্যাংকে কত টাকা আছে সেটাও শেখ হাসিনা জানেন। এইসব লোক যারা টাকা কামাবার জন্য রাজনীতিতে আসে- এইখানে ডাইরেক্টর, ওখানে কি, টেন্ডার বিক্রি করে এবং ইউনিয়ন নির্বাচনের আগে মনোনয়ন বাণিজ্য করে তাদেরকে মানুষ চিনে, তাদেরকে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করতে হবে।”
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান আরও বলেন, বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ইত্যাদি মেগাপ্রকল্প হচ্ছে সুনামগঞ্জে। আমাদের এখন কি দরকার সেটা ঠিক করতে হবে। প্রথম প্রয়োজন স্বাধীনতা যেটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমাদের এনে দিয়েছেন। আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি। এখন আমাদের প্রয়োজন সারা দুনিয়ার মানুষের মতো ভালভাবে, ভদ্রভাবে খেয়েপরে সম্মানের সাথে বসবাস করতে চাই। তাদের সাথে আমরা তাল মিলিয়ে চলতে চাই। কাজেই আমাদের প্রয়োজন উন্নয়ন, উন্নতি। জাতির পিতা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন, তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা উন্নতি করছি। এমন কোনও বিষয় নাই যা শেখ হাসিনার আওতার বাইরে। হাওরের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতেও বিদ্যুত পৌঁছে গেছে।
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি নূরুল হুদা মুকুট বলেন, “তারা বলেছে পরিকল্পনামন্ত্রী মহোদয় সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আপনাদের জেনে রাখা প্রয়োজন, আব্দুস সামাদ আজাদ যখন ছিলেন, তখন জেলা আওয়ামী লীগে কোনও কিন্তু কোনও গ্রুপিং ছিল না। কিন্তু বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আওয়ামী লীগে যোগদান করার পর গ্রুপিং সৃষ্টি করা হয়। আমাদের জেলা সেক্রেটারি মন্ত্রী মহোদয়কে ইঙ্গিত করে একটি বাজে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু দিরাই-শাল্লায় যখন উন্নয়ন শুরু হয় তখন তিনি ছাত্র, রাজনীতিতেও আসেন নাই।”
নূরুল হুদা মুকুট ব্যারিস্টার ইমনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আপনি আপনার বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। একজন সজ্জন ব্যক্তিকে নিয়ে আপনি যে অকথ্য কথা বলেছেন তার প্রতিবাদ জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই।”
তিনি আরও বলেন, দিরাই-শাল্লার এমপি জয়া সেনগুপ্তা নিজের কথায় চলেন না, তিনি চলেন ছাতক-দোয়ারার এমপি মুহিবুর রহমান মানিকের কথায়। কিন্তু মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী দিরাই-শাল্লাবাসীর জন্য যে সুযোগ সৃষ্টি করেছিলেন, মানিকের পাল্লায় পড়ে আপনাদের এমপি তার বিরোধিতা করে চলছেন। আপনাদের ভোটে নির্বাচিত এমপি আপনাদের বিরোধিতা করছেন, যেটা লজ্জা ও দুঃখজনক।
দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মজির উদ্দিনের সভাপতিত্বে ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রঞ্জন রায়ের পরিচালনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রেজাউল করিম শামীম, অবনী মোহন দাস, সৈয়দ আবুল কাসেম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, প্রয়াত আছাব উদ্দিন সরদারের ভাই আব্দুর রাজ্জাক সরদার মতালিব, দিরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম চৌধুরী, তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক স¤পাদক জাহাঙ্গীর চৌধুরী, শ্রম বিষয়ক স¤পাদক অ্যাডভোকেট আজাদুর রহমান রতন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ স¤পাদক ও দিরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র মোশাররফ মিয়া। বক্তব্য রাখেন উপজেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মোহন চৌধুরী, যুবলীগ নেতা শাহ আলম, রুবেল সরদার, উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ স¤পাদক উজ্জ্বল মিয়া।
উলেখ্য, শনিবার বিকেলে একই বিষয়ে আরও একটি শোকসভা আয়োজন করেছিল দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের অন্য একটি অংশ। সেখানে প্রধান বক্তার বক্তৃতায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমন দাবি করেছিলেন, “আওয়ামী লীগের একটি বড় দায়িত্ব নিয়ে আপনি (পরিকল্পনামন্ত্রী) মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। কিন্তু আপনার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগকে দ্বিখণ্ডিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা দেখেছি, আমাদের কাকাবাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ওখানে আপনি গিয়েছেন। আপনার পশুদের প্রতি ভালবাসা থেকে আমি অনেকটা উৎসাহ পেয়েছি। আপনি কাকাবাবুর কুকুরের জন্যও বিস্কুট নিয়ে যেতেন। আগামীতে এই ভালবাসা মানুষের প্রতি নিয়ে আসেন। যাদের নিয়ে চলছেন, বিস্কুট খাওয়াচ্ছেন তাদের দিয়ে আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চেতনা বাস্তবায়ন হবে না।” ব্যারিস্টার ইমনের এমন বক্তব্যে অনেককে নিন্দা জানাতে দেখা গেছে। তারা এই বিতর্কিত বক্তব্য প্রত্যাহরের দাবি জানান।