শামস শামীম, হাওরাঞ্চল ঘুরে ::
অতিমারি করোনায় সবচেয়ে বিপর্যস্ত শিক্ষাঙ্গন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সারাদেশের ন্যায় সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান শুরু হয়েছে। কিন্তু হাওরের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আশঙ্কাজনক কমে গেছে। দরিদ্র পরিবারের অনেক শিক্ষার্থী পরিবারের লোকদের সঙ্গে কর্মস্থলে চলে যাওয়ায় তাদের ঝরেপড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘ বন্ধের সময় মাদরাসাগুলো খোলা থাকার সুযোগে অনেক শিক্ষার্থী মাদরাসায় গিয়ে ভর্তি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সরেজমিন কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করে এই চিত্র লক্ষ করা গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর (২০২১ শিক্ষা বছর) জেলায় ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী প্রায় তিন লাখ বিদ্যালয়গামী শিশুর জরিপ করা হয়। গত ১২ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয় খোলার পর জেলায় শিক্ষার্থীদের গড় উপস্থিতি মাত্র ৭০ ভাগের কাছাকাছি। তবে দুর্গম হাওরের বিদ্যালয়গুলোতে এই উপস্থিতির হার ২০-৪০ ভাগ বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।
শিক্ষার্থীদের আশঙ্কাজনক অনুপস্থিতির কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদরা। করোনার কারণে মা সমাবেশসহ সচেতনতামূলক কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণেও উপস্থিতি কম বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টায় শাল্লা উপজেলার দুর্গম বিদ্যালয় নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় গ্রামের উত্তর মাথা ঘেঁষা বিদ্যালয়টির সামনে ভাণ্ডাবিল হাওরের পানি থৈথৈ করছে। গ্রাম ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বিদ্যালয়টি। গ্রামঘেঁষা স্কুলের সিঁড়ি দিয়ে যাতায়াত করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এসময় বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে দেখা যায় অফিস কক্ষে দাফতরিক কাজ করছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গুরুপ্রসাদ দাস। পঞ্চম শ্রেণির কক্ষে প্রবেশ করে দেখা যায় অর্পণ দাস নামের এক শিশু ক্লাসে এসেছে আজ। তাকে ইংরেজি পড়াচ্ছেন সহকারী শিক্ষক অরণজিত দাশ। তিনি ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে অর্পণকে বুঝাচ্ছেন পড়া। অন্য শ্রেণিকক্ষে কোন শিক্ষার্থী নেই। শ্রেণিকক্ষে একা হওয়ায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে বোঝাপড়া জমছিল না।
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানালেন এই বিদ্যালয়ে ৪ জন শিক্ষকের পদ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। বাকি তিনজনের মধ্যে একজন আছেন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। বিদ্যালয়ে ৯২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে ৫ম শ্রেণিতে ১৭ জন শিক্ষার্থী ভর্তি আছেন। বিদ্যালয় খোলার পর প্রতি ক্লাসে গড়ে ৫-৬ জনের বেশি বিদ্যালয়ে আসছে না বলে জানালো বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ৩০ সেপ্টেম্বর ৫ম শ্রেণির একমাত্র অর্পণ দাসই স্কুলে এসেছে। তাই তার একাই পাঠদান নিচ্ছিলেন শিক্ষক।
অর্পণ দাস জানায়, তার সহপাঠী বন্ধুদের অনেকেই বাবা মার সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। এ কারণে অনেকে বিদ্যালয়ে আসছে না। একা একা এভাবে তারও ক্লাস করতে ভালো লাগেনা বলে জানায় অর্পণ দাস।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গুরুপ্রসাদ দাশ বলেন, বিদ্যালয় খোলার পর অনেক শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে না আসায় আমরা তাদের বাড়িতেও গিয়েছি। যারা আসছেনা তাদের অনেকেই করোনায় কর্মহারা পরিবারের মা-বাবার সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। কর্মের খোঁজে শিশু সন্তানদের নিয়েও অনিশ্চিত পথে পা বাড়িয়েছে তারা। তিনি বলেন, এ গ্রামের সেজুতি দাস, রিভু দাস ও রিজন দাসসহ ৩য় থেকে পঞ্চম শ্রেণির বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী পরিবারের সঙ্গে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজে চলে গেছে। তারা কবে আসবে জানেন না তিনি।
এই চিত্র শুধু দুর্গম শাল্লা উপজেলায়ই নয়। তুলনামূলক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো এমন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী অনুপস্থিতির চিত্র লক্ষ করা গেছে।
সদর উপজেলার গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফাহমিদা আক্তার বলেন, বিদ্যালয় খোলার পর অনেক শিক্ষার্থী না আসায় তাদের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি বেশ কিছু শিক্ষার্থী স্থানীয় মাদরাসায় চলে গেছে। অনেক শিশু পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। তাই উপস্থিতি কিছুটা কম। তবে কিছুদিন গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এসএম আব্দুর রহমান শিক্ষার্থীদের আশঙ্কাজনক কম উপস্থিতির হারের কথা স্বীকার করে বলেন, আমিও শাল্লাসহ বিভিন্ন দুর্গম উপজেলায় ঘুরে এই চিত্র লক্ষ করেছি। তবে হাওরঘেরা জনপদে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে অনেক পরিবার শিক্ষার্থীদে বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না। তাছাড়া দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অনেকে মাদরাসাসহ ভিন্নধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলে গেছে। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে কাজে চলে গেছে। বর্তমানে জেলায় প্রায় ৭০ ভাগের কাছাকাছি শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই চিত্র থাকবেনা বলে জানান তিনি।