শহীদনূর আহমেদ ::
হাওরজেলা সুনামগঞ্জে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। পুকুর, নদী, জলাশয় কিংবা হাওর কোথাও আগের মতো দেশী মাছের দেখা নেই। এর প্রভাব পড়েছে জেলার সকল মাছের বাজারে। বেড়েছে দেশী মাছের দাম।
জানাযায়, হাওরে দেরিতে পানি প্রবেশ এবং সময়মতো মাছের প্রজনন না হওয়ায় এবার হাওরে মাছের উৎপাদন কম হয়েছে। মাছ উৎপাদনের এমন আকাল অবস্থার জন্যে হাওরপাড়ে নির্মিত অপরিকল্পিত বাঁধকে দায়ি করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে ফসলরক্ষার নামে জেলার বিভিন্ন হাওরের চারপাশে নির্মিত করা হয়েছে বাঁধ। বন্ধ করা হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নালা ও ক্লোজার। অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ করে পানির ধারা বন্ধ করার ফলে সময় মতো হাওরে পানি ঢুকতে পারেনি। ফলে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী মাছের প্রজনন না হওয়ায় মাছের উৎপাদন হয়নি। বাঁধ নির্মাণের নামে হাওর, জলাশয়ের সাথে নদীর পানির ধারা বন্ধ করে দিলে আগামীতে মাছের উৎপাদন আরও কমে যাওয়ার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন হাওর ও পরিবেশবিদরা।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জের হাওর, পুকুর, জলাশয়ে প্রতি বছর মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে ১ লাখ ৩ হাজার মেট্রিকটন। জেলায় মাছের চাহিদা ৫৫ হাজার মেট্রিক টন। আমিষের চাহিদা মিটে উদ্বৃত্ত থাকে ৪৮ হাজার মেট্রিক টন মাছ। মাছের উৎপাদন ও প্রজনন বৃদ্ধিতে সরকার রাজস্ব খাত থেকে প্রতি বছরে উপজেলাভিত্তিক লক্ষাধিক টাকার মাছের পোনা অবমুক্ত করে। চলতি বছরেও পোনা অবমুক্তকরণের কাজ চলমান রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদনে দেশের শীর্ষতম জেলা সুনামগঞ্জ। চিতল, পাবদা, রুই ও আইড় মাছের মতো সুস্বাদু মাছ এই জেলা থেকেই দেশে-বিদেশে সরবরাহ হয়। বছরে এই জেলায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি মাছের উৎপাদন হয়। সুনামগঞ্জে ৬২ হাজার হেক্টর প্লাবন ভূমি ও ২০ হাজার ৫০০ পুকুর রয়েছে। গত বছর জেলায় ৯৮ হাজার ২২৯ টন মাছের উৎপাদন হয়েছে ।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে সুনামগঞ্জে মাছের উৎপাদন দ্বিগুণ অর্থাৎ ৬ হাজার কোটি টাকার মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।
মাছ উৎপাদনের গতবছরের এমন তথ্য সম্ভাবনা দেখা দেলও এবার মিলছে ভিন্নতা। জলবায়ু পরিবর্তনে পাশাপাশি মানুষ সৃষ্ট নানাবিধ কারণ এবং অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণে হাওরে বিলম্বে পানি প্রবেশ করায় মাছের প্রজনন বিনষ্ট হয়ে হাওরবাসীকে দিয়েছে অশনিসংকেত। আবার একটি নির্দিষ্ট সময় পর হাওরের পানি কমতে থাকায় পোনা মাছগুলো বড় হওয়ার সুযোগ পায়নি। তাই এবার দেশী মাছের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার সাথে সাথে হাওর অঞ্চলে দেশী মাছের আরও সংকট দেখা দিতে পারে বলে ধারণা হাওরপাড়ের মানুষদের।
দেখার হাওর পাড়ের বাসিন্দা সদর উপজেলার ছলিম মিয়া বলেন, আমি একজন জেলে মানুষ। জাল বাইয়া মাছ ধইরা পরিবার চালাই। এবছর হাওরে মাছ নেই। সারাদিনেও একবেলার মাছ পাওয়া যায় না।
শামস উদ্দিন নামে আরেক জেলে বলেন, এবছর আষাঢ় মাসের পর হাওরে পানি আসছে। যে কারণে সময় মতো মাছ ডিম ফুটাতে পারেনি। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় তাড়াতাড়ি পানি কমে গেছে। এ জন্য মাছের পোনা বড় হচ্ছে না।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, মাছের উৎপাদন কম হওয়ার জন্যে দায়ি হাওরের অপরিকল্পিত বাঁধ। যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ করে পানির ধারা বন্ধ করায় হাওরে সময়মতো পানি প্রবেশ করেনি। নির্দিষ্ট সময়ের পর বাঁধের ক্লোজার কাটার কথা থাকলেও এর বাস্তবিক ফতিফলন হয়নি। যার কারণে পানির অভাবে মাছের প্রজনন ব্যাহত হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মন্ডল বলেন, এবার হাওরে দেরিতে পানি প্রবেশ করায় মাছের প্রজনন ঠিকমতো হয়নি। এ কারণে মাছের উৎপাদন কম হয়েছে। হাওরে মাছের উৎপাদন কম হলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে। কেননা এবার পুকুর জলাশয়ে প্রচুর মাছ চাষ হয়েছে। জেলার বিভিন্ন হাওরে ১০ লাখ ৪০ হাজার টাকার মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।