:: মোহাম্মদ আব্দুল হক ::
দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা। পরবর্তীতে দেশ আবার উল্টোপথে যাত্রা শুরু করে। একাত্তরের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়। দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নিতে যা করা দরকার তা-ই করতে থাকে শাসকরূপী শোষকরা। তবে বাংলাদেশ মাথা নোয়াবার নয়, আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। চলছে বঙ্গবন্ধু তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সোনার বাংলা গড়ার বিশাল কর্মযজ্ঞ।
দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগ এখন অনেক বেশি সংগঠিত। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী করেছিল এবং এভাবেই আওয়ামী লীগ তখন নীতিগতভাবে নেতৃত্ব পেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান তা মেনে নেয়নি। তাই সংগ্রাম। এই দলটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তার চরিত্র ধরে রাখতে যথেষ্ট সচেতন। দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধীকে প্রশ্রয় দেয়নি।
২০০১ সালের পরে বিএনপি প্রকাশ্যে স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে, তখন আমি হতবাক হয়ে যাই। কারণ, আমি যখন স্কুলের ছাত্র তখন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে আমি হ্যান্ডশেক করেছিলাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ছোঁয়া পেয়েছিলাম।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যখন এ দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামের কতিপয় নেতাকে নিয়ে সরকার গঠন করেন, সেসময় কোনো একটি দৈনিক পত্রিকা প্রখ্যাত লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের একটি লেখা ছেপেছিল। সেদিনের লেখায় দেশের স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীর গাড়িতে দেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ছুটে চলা নিয়ে খুব আবেগ মাখানো ক্ষোভ প্রকাশ হয়েছিলো, যা আমাকে ছুঁয়ে যায়। ওই লেখা পড়ে, আমি আমার সুনামগঞ্জের বিলপাড়ের বাসায় বসে একটি চিঠি প্রিয় লেখক ও স্যারকে লিখেছিলাম যার মূল কথা ছিলো, স্যার পত্রিকায় আপনার লেখা পড়েছি। কিন্তু এতো লিখে কি হলো, স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে শেষ পর্যন্ত আমাদের জাতীয় পতাকা উঠে-ই গেল।
দেশে যখন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় জোটের সরকার, তখনও এখনকার মতো হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিলো না বা আমাদের মনের কথা লিখে প্রকাশ করার মতো আমাদের ফেসবুকের দেখা মিলেনি। মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার তখন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমি তাঁকে লিখা চিঠিটি সুনামগঞ্জের প্রধান ডাকঘরে গিয়ে খামে ভরে দুই টাকার ডাক টিকেট লাগিয়ে হলুদ খামের একপাশে মুহম্মদ জাফর ইকবাল, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট ও ওপর পাশে আমার নাম ও ঠিকানা লিখে ডাক বাক্সে ফেলে দিয়েছিলাম। খুব মনে পড়ে, ডাক টিকেটে আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েল পাখির ছবি ছিল। আমি বর্তমান সময়ের অনেক ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তারা ডাক টিকেটের ব্যাপারে কোনো ধারণা করতে পারে না। সে যা-ই হোক, স্যার চিঠি পাবেন কি-না জানি না এবং পেলেও ব্যস্ততার মধ্যে আমার চিঠি পড়ে জবাব লিখে পাঠাবেন এমনটি আমি ভাবতে পারিনি। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে ডাক পিয়ন আমাকে অবাক করে দিয়ে বাসায় এসে আমার হাতে একটি হলুদ খাম ধরিয়ে দিলেন। স্যার অত্যন্ত বিনয়ের সাথে এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে যা লিখেছিলেন তার মর্মার্থ ছিলো, আপনার মতো মানুষেরা সারাদেশে আছেন বলেই লিখি এবং লিখতে হবে। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস আছে, বিজয়ের ইতিহাস আছে। কাজেই আমাদের হতাশ হবার কিছু নেই। একদিন সবকিছুর বিচার হবে।
সত্য হলো, সারাদেশব্যাপী সকল সরকারের সময়ে অবকাঠামো উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়েছে। তবুও আমাদের শান্তি হলো না। স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় অর্ধ শত বছরেও আমাদের দেশের মানুষের মাঝে সুখের সন্ধান পাওয়া যায় না। এমন অবস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। লক্ষ্য স্থির রাখতে না পারা সংগঠনের ভুলের কারণেই দিনে দিনে আমরা আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছি যেখানে ধর্ষণ, ঘুষ, লুটপাট, অন্যায়, গুম, খুন, চুরি সংবাদ মাধ্যমে দৃশ্যমান। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গরিব মানুষের জন্যে ঘরের ব্যবস্থা করে দিলেন যেখানে, সেখানেও লুটেরাদের লুটপাট প্রকাশিত।
ঘুষ দুর্নীতিতে বাংলাদেশের সরকারি অনেক চাকরিজীবী এগিয়ে, যা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রায় প্রতিদিন। বলতে-ই হবে দেশে নানা রকম সংকট থাকলেও সরকার চাকরিজীবীর সাথে চুক্তি মোতাবেক বেতন প্রদান করতে গিয়ে কোনো চুক্তি ভঙ্গ করেনি। কিন্তু চাকরিজীবীদের এক অংশ ঠিকই জনগণের সাথে দেশের সাথে বেইমানি করে ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। এ খুবই লজ্জাজনক এক ব্যাপার। পাশাপাশি এ কথা-তো স্বীকার করতে হবে যে, রাষ্ট্রের বা সংগঠনের ক্ষেত্রে যা-ই ঘটুক-না কেন, নেতৃত্বে থাকা বা দায়িত্বে থাকা নেতা বা কর্তৃপক্ষকে দায় নিতে হয়।
সহজে বুঝি একটি দেশের সবকিছুই চলে রাজনীতির পরিকল্পনা মতে। যখন যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকেন তাদের প্রাধান্য এ ক্ষেত্রে বেশি। রাজনীতিতে নাকি অনেক কৌশল ও সাপ-লুডু খেলার মতো নানান ঘোরপ্যাঁচ আছে, যা খেলতে হয়। আমি রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ বুঝি না। তাই কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাই না। তবে প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে বাজেটের সময় আসে, স্বাধীনতার মাস আসে, বিজয়ের মাস আসে, বৈশাখী ফসল আসে, অগ্রহায়ণ মাসের ফসল আসে, ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মাছ আসে, মাসে মাসে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পায় এবং বাংলাদেশের মানুষ হাসে। তখন কিছু কিছু বিষয় চোখের সামনে আশার প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠে। কিন্তু টেকনাফের বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ ও তার অনুসারীরা আশার আলোটুকু নিভিয়ে অন্ধকার গর্তে সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটাতে তৎপর থাকে। এ বিষয়ে নেতৃত্বকে আরো দৃঢ়তা দেখাতে হবে।
আজ পুরনো কাগজপত্র রাখার ফাইল তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। নাই কোথাও নাই। আমার লেখা চিঠির জবাবে আমাকে লেখা মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের সেই চিঠি খুঁজে পাইনি। তবে হ্যাঁ, স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা যারা করেছে তাদের বিচার হয়েছে, ফাঁসি হয়েছে। ইতিহাস বলে, যখন যারা দেশের মানুষের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজনীতিতে কৌশলে ভুল করে দেশবাসীকে আঘাত করেছে, অপমানিত করেছে তারা পরবর্তীতে হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে যায়।
আমি তারুণ্যের মাঝে আশার চিঠি খুঁজি। আশাবাদী এবং শুদ্ধতার চর্চায় নিয়োজিত তরুণ-তরুণী ও সৃজনশীল মানুষের কাছে বলি – হে তারুণ্য অরুণ হও আর জ্বালিয়ে যাও আলো। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যেহেতু আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জ্বলে উঠার ইতিহাস আছে, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস আছে এবং আমাদের বিজয় দিবস আছে, কাজেই আমাদের পুরোপুরি অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নাই। গৌরবের ইতিহাসের যেটুকু আলো আমাদের আছে – চলো আলো জ্বেলে যাই।
[মোহাম্মদ আব্দুল হক : কলামিস্ট ও সাহিত্যিক]