বিশেষ প্রতিনিধি ::
সড়ক যোগাযোগ উন্নত হওয়ায় নদীমাতৃক বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় নৌকার কদর কমে গেলেও বারকি নৌকা জীবনযুদ্ধে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত বারকি শ্রমিকদের কাছে। হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলার নৌকার ইঞ্জিনের ব্যবহার করে দ্রুত চলাচল করলেও বারকি শ্রমিকদের জন্য অন্যতম ও জীবিকার অন্বেষণের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় সুনামগঞ্জের ধোপাজান, ছাতকের চেলা নদী, তাহিরপুরের যাদুকাটা নদী, ফাজিলপুরসহ বিভিন্ন বালু-পাথর মহালে।
এছাড়াও অনেকেই এখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত চলাচলে বারকি নৌকায় ইঞ্জিন বসিয়েছে যাত্রী পরিবহন করছে। আর শ্রমিকদের বারকি নৌকার চাহিদা মেটাতে জেলার বিভিন্ন গ্রামে বারকি নৌকা তৈরি ও বিক্রি করে কারিগররাও জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন যুগযুগ ধরে।
সুনামগঞ্জ শহরতলির মাইজবাড়ি এলাকার রয়েছে শাপলা, হাতি, ময়ুর, হুক্কা, লাঙ্গল, তারা, অরত, চাঁদ, দোয়েল, পতাকাসহ ১০-১৫ আড়ং। যারা নৌকা বানায় তাদের আড়ং নামে পরিচিত। যাদুকাটা নদীর সোহালা গ্রামের ও মিয়ারচর গ্রামে রয়েছে আরও ৫টি আড়ং। এছাড়াও জেলার তাহিরপুর উপজেলা, মধ্যনগর, ছাতক উপজেলা, দোয়ারাবাজার উপজেলা, জামালগঞ্জ উপজেলার নজাতপুর, সেরাস্তাপুর, বাগগোয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে নৌকার কারিগররা নৌকা তৈরি করে (আড়ং রয়েছে) নৌ-শ্রমিকদের চাহিদা অনুযায়ী তাদের বাড়িতে গিয়েও বারকি নৌকা তৈরি ও মেরামত করে দেন।
জেলার তাহিরপুর উপজেলার কাউকান্দি বাজার, মধ্যনগর বাজার, জাউয়া বাজার, মাইজবাড়ি, জামালগঞ্জে নৌকা বিক্রির হাট রয়েছে। আর সেখানে অন্যান্য নৌকা বিক্রির পাশাপাশি বারকি নৌকা প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। আর এই বারকি নৌকা কিনে নেন হাওরপাড়ের শ্রমিকরা। তারা উপজেলার যাদুকাটা, ফাজিলপুরসহ জেলার বিভিন্ন বালু ও পাথর কোয়ারিতে এই নৌকা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
কথা হয় নৌকা তৈরির কারিগর আলী নুর মিয়ার সাথে। তিনি জানান, প্রায় ৩০ বছর ধরে নৌকা বানানোর পেশায় আছেন তিনি। সংসার মোটামুটি ভালই চলে। বর্ষাকালে ৩মাস নৌকা তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকেন। ৩-৪ দিনে ১৫ থেকে ২০হাত লম্বা একটি নৌকা বানাতে খরচ হয় ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। বাজারে নৌকা বিক্রি করেন ১৮ থেকে সাড়ে ১৮ হাজার টাকায়। নৌকা বিক্রির লভ্যাংশ ছাড়াও আরও ২/৩শত টাকার লাকড়ি আয় হয়। রেইনট্রি, জারুল, কদম, চাম্বল, কোমাসহ বিভিন্ন কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করা হয়। একেক কাঠের নৌকার দাম ভিন্ন-ভিন্ন।
তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের পাতারগাঁও গ্রামের বারকি শ্রমিক সাইফুল ইসলাম জানান, আমি এক বছর পূর্বে মাইজবাড়ি আড়ং থেকে ১৮ হাজার (২৩ হাত দৈর্ঘ্য ও সাড়ে তিন হাত প্রস্থ) টাকায় নৌকা অর্ডার দিয়ে কিনে এনে আরও কিছু কাজ করতে হয়েছে। প্রথমে বালু ও পাথর পরিবহন করতাম যাদুকাটা নদীতে। এখন দ্রুত চলাচলের জন্য নৌকায় ইঞ্জিন বসিয়ে বিভিন্ন স্থানে মানুষজন পরিবহন করি। আমার মতো অনেকেই আছে যারা এই বারকি নৌকা দিয়ে বালু ও পাথর পরিবহন করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন।
যাদুকাটা নদীর বালু ও পাথর শ্রমিক সাকিবুল মিয়া বলেন, বালু ও পাথর মহালে বারকি ছাড়া কাজ করার সুযোগ নেই। এই বারকিই আমাদের জীবন-জীবিকার প্রধান হাতিয়ার। বালু ও পাথর মহাল থেকে বালু ও পাথর সংগ্রহ করে নৌকার করে নদীর তীরে জমা করি, না হয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেই।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণাসিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, তাহিরপুর উপজেলাসহ জেলার অনেক গ্রামে বংশপরম্পরায় অনেকেই বেকার না থেকে নৌকা তৈরির কাজে নিয়োজিত হয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাদের আরও পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।