:: মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী ::
নদীর বুকে পৃথিবীটা খুবই নিখুঁত এবং শীতল
হাওরের শান্তজলে নিসর্গের ডানামেলে
সদা হাতড়ে চলে বিমর্ষ চিতল;
হরেক জাতের রাঙা মাছ হেলেদুলে সন্তরণে
মাতে আর্শি নদীর স্রোতের বিপরীতে,
উৎসবের নাগরদোলায় যেন-
অন্তহীন মেতে ওঠে জীবনের প্রপাতে
কেবলই পুড়ে হয় খাক পাথুরে লাভা
দুর্বিনীত আগ্নেয়গিরির ভালে – পৃথিবীর যাতাকলে
দাবানলের লেলিহান শিখা দহন যন্ত্রণায় কাঁদে
অসহায় সবুজ বৃক্ষ বাঁচানো অমিয় ছলে
আমাজনের সবুজ অরণ্যের বৃক্ষদেবী।
আগুনের কুণ্ডলীপনায় উড়ে যায় মৃত্তিকা
নির্যাসের অনুশ্বাস হারানো অনুষঙ্গে
পাষাণ শ্মশানের চিতার আগুনের মতোই
অপ্রতিরোধ্য বিদেহী গীতিকা।
অতঃপর জ্বলে নিঃশেষ হয় কত সুদর্শন
দেহের আরাধ্য মন্দাকিনী সৌন্দর্য
আর হেরে যায় মানব মোহের মিসমার
বিলীয়মান নিঃশ্বাসের মন্দাক্রান্তা সৌকর্য।
নাতিশীতোষ্ণ পৃথিবী কখনও-
ছড়িয়ে দেয় তার নীল আঁচল ধরণীতলে অবিরত
একাকী রাত্রে কৃষ্ণ-আঁধারে সোনালী জরির মতো
জোনাকিরা মকশো জ্বেলে উড়াউড়ি করে;
সরব হয় ঝোপঝাড়ের বিষাদে বিরান বিক্ষত।
আবার হিমবাহের বরফগলে
পৃথিবীর বাতাসে মিলিয়ে যায় যখন হিমজল
শীতের আগমনে জবুথবু হয়ে পড়ে
প্রকৃতির নাদান ক্ষুধাতুর দেহকল
অপ্সরীর ওষ্ঠ থেকে খসেপড়া সুখ চুম্বনের পর
নির্গত সুঘ্রাত মসৃণ লালার মতোই মাহেন্দ্রক্ষণ
পঞ্চদশীর রাতে নক্ষত্রের আলো জ্বলা
অশরীরী শিশির কণা চড়ানো গহীন মন
ওরা আকাশ থেকে ঝরে
নিরাপদ ওমের সন্ধানে লোকালয় ছেড়ে পালায়
মানুষরূপী শ্বাপদ মৃত্তিকার অতল
অন্তরালের অনন্ত বিরহ জ্বালায়।
অবিরাম জলধারার তৃষ্ণায়
বর্ষায় পৃথিবী ছড়িয়ে দেয় তার অশ্রুডানা
যেন তাদের ওই পৃথিবী ছোঁয়া মানা
বর্ষার মতোই ছবি আঁকে তারা আনমনে বিমনা
অতঃপর, শাদা মেঘমালা মিশে যায়
রাজহাঁসের উষ্ণপালকে অপসৃয়মান,
বৃষ্টিস্নান সারে জোৎস্না রাতে ঝলমলে নক্ষত্রগুলো
এক এক করে খসে পড়ে জলজঙ্গলে বহমান।
তারা কৃষ্ণকাঞ্চনে একাকী নিয়তিভুলো
কিংবা আকাশ ভেঙে পড়ে নক্ষত্র নদীর
জখমের ঢেউয়ের মদিরার চালচুলা।
সদ্যফোটা বকুল, কদম, সন্ধ্যামালতী,
আর অসহায় চন্দ্রমল্লিকা
বৃষ্টিভেজা বাতাসের ঘ্রাণে উন্মাতাল
হয়ে ওঠে দুস্তর দাম্ভিক কুহেলিকা।
আমি তখন নির্বেদ বিশ্বাস নিয়ে ব্যতিব্যস্ত
বৃষ্টিময় নরমী সান্ধ্য আয়োজনে
দিঘীর পাড়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে অনুভব করি
অনস্তিত্বের হাহাকার আবেগীয় বিয়োজনে
যেনো প্রিয়তমার তৃষ্ণা নেভানো
সেই দীর্ঘশ্বাস আমায় স্বপ্নপালে তখন নির্ভার
গত জন্মের ভালোবাসা খুঁজে ফিরি বারেবার।
পৃথিবী এভাবেই রঙ বদলায়
বদলে যায় প্রকৃতি নিয়তির ছলা কলায়
শ্রীপৃথিবী জানে বদলে বদলে অনন্তকাল
বেঁচে থাকাটাই মৃত্যুর তূণের ছিলায়
(মৃত্যু) – এই তো বিধাতার বেঁধে দেয়া নিয়তিবৃত্ত।
মানুষও বদলায়, বদলায় প্রতিশ্রুতি মুখঃনিসৃত
কিংবা প্রতিশ্রুতি নিঃসৃত মুখাবয়বের মন্ত্রজাল,
কে করে কার এই পৃথিবীতে দেখভাল!
মানুষ জানে না মানুষের জীবনের মানে কী!
যেন চক্রজালে আঁকড়ে থাকা অমিত
দিকচক্রবালে পড়ে থাকা ভাঙা শানকি।