বাঙালির রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য ও গৌরবময় ইতিহাস। বাঙালি বিশ্ব ইতিহাসে বীরের জাতি হিসেবে পরিচিত। ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, বাঘা যতিন, সিরাজ দৌলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার। বাঙালি জাতি পূর্ব বীর পুরুষের পথ অনুসরণ করে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্থান লাভ করে প্রিয় স্বদেশ ভূমি বাংলাদেশ। আমরা এই স্বাধীন রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক। বিশ্ব ইতিহাসে যেসব রাষ্ট্র সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে তারা কখনো স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত করেনি। সত্যনিষ্ঠ, স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস দিয়ে স্ব স্ব জাতির ইতিহাস রচিত হয়েছে। তারা কখনো ইতিহাস বিকৃত করে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার হীনঅপচেষ্টায় লিপ্ত হয় না। এর একাধিক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মিথ্যা ইতিহাস দিয়ে কোনো জাতির ভিত রচিত হতে পারে না। মিথ্যা, সাজানো, বিকৃত ইতিহাস দিয়ে কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। সর্বোপরি তারা ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ। তারা বারবার ইতিহাসের কাছে ফিরে যায়। প্রকৃত বাস্তবতা হলো ইতিহাস পরিবর্তন করা যায় না। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি স্বাধীন বাংলাদেশে একাত্তরের পরাজিত সেই অপশক্তি বারবার আমাদের গর্বিত ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তারা সত্যকে লুকিয়ে রেখে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে চায়। তাদের অপতৎপরতা এখনো বিদ্যমান।
আমাদের দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার উজানিগাঁও রশিদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ সংলগ্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক হয়ে আছে। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধূলিস্মাৎ করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
গতকাল দৈনিক সুনামকণ্ঠে ‘দুই যোদ্ধাকে বাদ দিয়ে এক যোদ্ধার নামে ফলক’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে, উজানিগাঁও রশিদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ সংলগ্ন সমাধিতে মুসলিম, হিন্দু এবং খ্রিস্টান ধর্মের মৃত্যুঞ্জয়ী তিন মুক্তিযোদ্ধা পাশাপাশি শুয়ে আছেন ১৯৭১ সন থেকে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক হিসেবে সমাধিটি যুদ্ধের পর থেকেই বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে আসছে। সরকারিভাবে প্রতিটি স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে তিন যোদ্ধাকেই শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা-জনতা। এখনো জাতীয় দিবসগুলোতে সরকারিভাবে তিন যোদ্ধাকেই শ্রদ্ধা জানানো হয়ে থাকে। তিন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তালেব আহমদ, মুক্তিযোদ্ধা কৃপেন্দ্র দাস এবং নাম না জানা আরেক মুক্তিযোদ্ধা।
সম্প্রতি স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধী একটি গোষ্ঠী গোপনে শহীদ কৃপেন্দ্র ও নাম না জানা অন্য ধর্মাবলম্বী আরেক শহীদকে বাদ দিয়ে কেবল শহীদ তালেবের নামে ফলক লাগিয়ে স্মৃতিসৌধটি সংস্কারও করেছে। ফলকে কেবল শহীদ তালেবের কথাই লেখা রয়েছে। অন্য দুই শহীদের বিষয়টি চেপে যাওয়া হয়েছে। যা ইতিহাস বিকৃত করার সামিল। এই চক্রান্তের সঙ্গে যে বা যারা যুক্ত তারা সুস্থ মস্তিষ্কে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে। ঐতিহাসিক সত্যকে বিকৃতকারীদের অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। আমরা চাই, তিন শহীদের নামেই ফলক নির্মাণ হোক। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে অবশ্যই উদ্যোগী হতে হবে।