স্টাফ রিপোর্টার ::
ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর থানাকে উপজেলায় উন্নীত করেছে সরকার। নতুন উপজেলা নিয়ে সুনামগঞ্জ জেলায় মোট উপজেলার সংখ্যা দাঁড়াল ১২। আর দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে শান্তিগঞ্জ। সোমবার (২৬ জুলাই) প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) ভার্চ্যুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, মধ্যনগরসহ তিনটি থানাকে উপজেলায় উন্নীত করেছে সরকার। এগুলো হলো মাদারীপুরের ডাসার, কক্সবাজারের ঈদগাঁও। তিনি বলেন, ধর্মপাশা থেকে ২৫-২৬ কিলোমিটার দূরে মধ্যনগর। এটি হাওরের মধ্যে অবস্থিত। এটা রিমুট এলাকা। এলাকার লোকজনেরও খুবই অসুবিধা হয়। সরকার মনে করে সেখানে একটা ইউনিট দরকার। এজন্য সরকার অনুমোদন করে দিয়েছে। দেশে ৪৯৫টি উপজেলা হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, নিকারের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে এরপর আর শর্তপূরণ না হলে উপজেলা করা হবে না।
অপরদিকে, এলাকার লোকজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নাম পরিবর্তন করে শান্তিগঞ্জ রাখা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি বলেন, এখন থেকে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা শান্তিগঞ্জ উপজেলা নামে পরিচিত হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বৈঠকে দোহার পৌরসভার সীমানা যোগ-বিয়োগ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে (শাবিপ্রবি) সিটি করপোরেশনের আওতায় আনা হয়েছে।
জানাযায়, ১৯৭৪ সালে ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর, চামরদানী, বংশীকুণ্ডা উত্তর ও বংশীকুণ্ডা দক্ষিণ – এই চারটি ইউনিয়ন নিয়ে মধ্যনগর থানা গঠিত হয়। ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে মধ্যনগর থানাকে উপজেলায় উন্নীত করার জন্য প্রাথমিকভাবে কার্যক্রম শুরু করা হয়। এরপর এই দাবিতে বিভিন্ন সময়ে মধ্যনগর বাজারে অনশন, মানববন্ধন ও হরতালের মতো কর্মসূচিও পালন করা হয়।
২০০১ সালের ৯মে নিকার ৮৬তম বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মধ্যনগর থানাকে উপজেলায় রূপান্তরিত করার জন্য অনুমোদন দেন। কিন্তু ২০০৩ সালের ১৮ জানুয়ারি নিকার ৮৮তম বৈঠকের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই অনুমোদনটি বাতিল করে দেন। এ অবস্থায় মধ্যনগরের চার ইউনিয়নের বাসিন্দাদের স্বপ্ন থমকে যায়। এরপর মধ্যনগর উপজেলা বাস্তবায়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী বরাবর এ নিয়ে আবারও আবেদন করা হয়। অবশেষে দীর্ঘ ৩৪ বছরের এই প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চারটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত উপজেলার মধ্যনগরের আয়তন ২২১ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী জনসংখ্যা রয়েছে ৯২ হাজার ৭৪৫ জন। শিক্ষার হার শতকরা ২৯ দশমিক ০২ শতাংশ। এখানে ৮৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১০টি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ১টি কলেজ রয়েছে। এ ছাড়া মোট কৃষি জমির পরিমাণ ১৫ হাজার ৬০০ হেক্টর।
সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মধ্যনগর থানাকে নিকার সভায় উপজেলা হিসেবে অনুমোদন দেওয়ায় আমরা গর্বিত ও আনন্দিত। হাওরবাসীকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই ভালোবাসেন। হাওরবাসীর দীর্ঘবছরের স্বপ্ন আজ প্রধানমন্ত্রী পূরণ করেছেন। এটি শুধু আমার নয়, এখানকার হাওরবাসীর জন্য এই দিনটি জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে।
অপরদিকে, প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ একসময় সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সঙ্গে যুক্ত ছিল। জেলা শহরের দক্ষিণে হওয়ায় এটি দক্ষিণ সুনামগঞ্জ এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। সদরের ১৭টি ইউনিয়নের মধ্যে আটটি ইউনিয়ন ছিল দক্ষিণ সুনামগঞ্জে। একপর্যায়ে এই আটটি ইউনিয়ন নিয়ে দক্ষিণ সুনামগঞ্জকে পৃথক উপজেলা গঠনের দাবি ওঠে। এরপর ২০০৬ সালের ২৭ জুলাই দক্ষিণ সুনামগঞ্জকে উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করে সরকারিভাবে গেজেট প্রকাশিত হয়। ২০০৮ সালের ১৮ মে থেকে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে জেলা শহরের পুরোনো কালেক্টরেট ভবনে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু হয়। ২০০৯ সালে এখানে প্রথম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয়। প্রায় পাঁচ বছর এখানে কার্যক্রম চলে। পরে ২০১২ সালে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার শান্তিগঞ্জ এলাকায় প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের পর সেখানে কার্যক্রম স্থানান্তর করা হয়। শান্তিগঞ্জ এলাকাতেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া পরিষদের অন্যান্য দপ্তরের ভবন নির্মাণের কাজও এখানেই শুরু হয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের বাড়িও এই উপজেলায়। ২০১৯ সালের শুরুতে উপজেলার রাজনৈতিক মহল, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ এই উপজেলার নতুন নামকরণের বিষয়টি পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন। একই দাবিতে তাঁরা বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেছেন। পরে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে উপজেলার নাম শান্তিগঞ্জ করার পক্ষে মতও দেওয়া হয়। একই বছরের ১৬ মে উপজেলার মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় উপজেলার নাম পরিবর্তন করে শান্তিগঞ্জ রাখার পক্ষে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়। এরপর সিদ্ধান্তের বিষয়টি পরিকল্পনামন্ত্রীকে অবহিত করা হয়।
সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের শুধু নাম পরিবর্তন হয়েছে। আর মধ্যনগর নতুন উপজেলা হয়েছে। মধ্যনগরবাসীকে অভিনন্দন। এটা তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, এই দাবির সঙ্গে আমরাও একাত্ম ছিলাম। তিনি বলেন, ফাইলটি দীর্ঘদিন চাপা পড়ে ছিল। এ নিয়ে আমি বিভিন্ন জায়গায় কথা বলেছি। শেষ পর্যন্ত মধ্যনগর উপজেলা হয়েছে, এতে মধ্যনগর এলাকার মানুষের সঙ্গে আমরাও খুশি। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান আরও বলেন, সুনামগঞ্জের দক্ষিণ সুনামগঞ্জ আর সিলেটের দক্ষিণ সুরমা – এই দুই নাম নিয়ে অনেক সময় জটিলতার সৃষ্টি হতো। এক উপজেলার বরাদ্দ-চিঠিপত্র চলে যেত আরেক উপজেলায়। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও অনেক সময় সমস্যায় পড়তেন। এখন দক্ষিণ সুনামগঞ্জের নাম শান্তিগঞ্জ হওয়ায় আর এই ঝামেলায় পড়তে হবে না।