:: মোঃ শাহাদত হোসেন ::
ফুটবল ইতিহাসে AB মানে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল অনন্য দুটি দলরে নাম। ফুটবলের জন্ম ইউরোপে হলেও দক্ষিণ আমেরিকার এ দুটি দেশ ফুটবলের রোমাঞ্চ ছড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী। শতবছরের বেশি সময় ধরে দর্শক-সমর্থকদের মনে দোলা দেয়া এ দুটি দেশ ফুটবল দুনিয়াকে দুটি ভাগে বিভক্তও করে ফেলেছে। তাই আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ম্যাচ মানেই বাড়তি আনন্দ, বাড়তি উত্তেজনা, বাড়তি রোমাঞ্চ। আর সেটি হয় যদি আন্তর্জাতিক ফুটবলের কোন ফাইনাল, তবে সেটিকে নিঃসন্দেহে ‘স্বপ্নের ফাইনাল’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
ফুটবল বাংলাদেশের অতি জনপ্রিয় খেলা। একসময় আবাহনী-মোহামেডান মাঠে যেমন উত্তাপ ছড়াত, তেমনি উত্তাপ ছড়াত দর্শক-সমর্থকদের মনেও। কিন্তু নানা কারণে আমাদের ফুটবল ক্রমঃনিম্নমুখী হয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে ফুটবলপ্রেমীদের মন থেকে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা একেবারে কমে যায়নি। দেশের ফুটবলপ্রেমীদের বড় অংশই এখন শুধু আন্তর্জাতিক ফুটবল নিয়েই মেতে থাকতে ভালোবাসেন। এদেশে জার্মানি, ফ্রান্স, ইতলি, স্পেন, ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জাপান, ইরান প্রভৃতি দেশের সমর্থক আছেন। তবে এসব সমর্থকদের বড় অংশই আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ফুটবলকে ভালোবাসেন। অর্থাৎ আমাদের আন্তর্জাতিক ফুটবলপ্রেমীদের অধিকাংশই আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলকে সমর্থন করে থাকেন।
কেন, কিভাবে আমাদের দেশে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল ফুটবলের এত বিশাল সমর্থক-গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে তা এক রহস্যই বটে। তবে এতে পেলে ও ম্যারাডোনার যে অবদান আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ফুটবলের এ দু’মহারথি বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদেরকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছেন।
তাই আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ফুটবল ম্যাচের উন্মাদনা শুধু আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলেই সীমাবদ্ধ থাকে না। সীমানা ছাড়িয়ে সে উত্তাপ, সে উন্মাদনা বাংলাদেশকেও গ্রাস করে। আমার মনে হয়, উক্ত দু’দলের ম্যাচ নিয়ে আর্জেন্টিানা ও ব্রাজিলের বাইরে একমাত্র বাংলাদেশেই এতটা আগ্রহ-উদ্দীপনা দেখা যায়। হাজার মাইল দূরের এ দু’দেশের মহারণ নিয়ে বাংলাদেশও রণক্ষেত্রে পরিণত হয়- এক দলের সমর্থকদের আক্রমণে আহত হয় অন্য দলের সমর্থকরা।
সম্প্রতি প্রায় একই সময়ে কোপা আমেরিকা ও ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা শুরু হয়। করোনাকালে মানুষের কাছে এটি ছিল বিনোদনের বাড়তি খোরাক। তাই ঘরে বসে অবসরে অনেকেই টিভিতে ফুটবল খেলা দেখায় মগ্ন থাকছেন। তবে টুর্নামেন্ট দুটি শুরুর দিকে ইউরো যেভাবে দর্শকদের কাছে টানতে পেরেছিল, কোপা তা পারেনি। কিন্তু সেমিফাইনাল সামনে আসতেই পট পাল্টাতে থাকে। ইউরো থেকে জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন বিদায় নেয়ায় এর উত্তাপ কমতে থাকে। অন্যদিকে কোপায় আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ফাইনাল খেলার সম্ভাবনা বাড়তে থাকায় দেশের আপামর দর্শক-সমর্থকদের মনে উদ্দীপনার পারদ তুঙ্গে উঠতে থাকে।
অবশেষে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে সেমিফাইনালে ব্রাজিল পেরুকে হারিয়ে এবং আর্জেন্টিনা কলম্বিয়াকে হারিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করে। বিশ্ববাসী প্রায় চৌদ্দ বছর পর আবার একটি স্বপ্নের ফাইনাল দেখার সৌভাগ্যের সম্মুখীন হয়। এখন চারিদিকে বাজছে ধ্রুপদি লড়াইয়ের ডঙ্কা, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল মহারণে কাঁপছে ফুটবল বিশ্ব। তবে এ লড়াইয়ের শুরু আজকে নয়, এ লড়াই শত বছরের পুরোনো। বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা গঠিত হবার পূর্ব থেকেই আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল দ্বৈরথ মানেই আলাদা কিছু। পরবর্তী সময়ে পেলে-ম্যারাডোনা সে দ্বৈরথে ঘি ঢেলে দেন।
সেই ১৯০৮ সাল থেকে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল দ্বৈরথ চলে আসছে। সাও পাওলোতে ২ জুলাইয়ে মুখোমুখি হওয়া সে ম্যাচটি ২-২ গোলে ড্র হয়েছিল। সেসময় থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত মোট ১৬ বার মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল। তন্মধ্যে ১৩টি ম্যাচ জিতে আর্জেন্টিনা, ২টি ম্যাচ জিতে ব্রাজিল, ১টি ড্র হয়। তবে এ ম্যাচগুলো ফিফা অনুমোদিত নয় বলে সাধারণত হিসেবে ধরা হয় না।
ফিফা অনুমোদিত ম্যাচে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল প্রথম মুখোমুখি হয় ১৯১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বরে। বুয়েনস এইরেসের সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনা বিজয়ী হয় ৩-০ গোলে। সে থেকে এখন পর্যন্ত আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে ১০৭ বার। এরমধ্যে আর্জেন্টিনা ৩৯ ম্যাচে, ব্রাজিল ৪৩ ম্যাচে জয়ী হয় এবং ২৫টি ম্যাচ ড্র হয়। এসময় আর্জেন্টিনা গোল করেছে ১৬১টি, ব্রাজিল ১৬৬টি। আন্তর্জাতিক এসব পরিসংখ্যান স্পষ্টতই বুঝিয়ে দেয় যে, আসন্ন কোপা ফাইনালে লড়াই হবে সেয়ানে সেয়ানে।
একটি ছোট্ট পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দু’দেশের ফুটবলের সামর্থ্যটা অনুধাবন করা সহজ হবে।
আসলে শুধু ফাইনাল নয়, কি বিশ্বকাপ বা কোপার বাছাই পর্ব, বড় কোন টুর্নামেন্ট, এমনকি ফ্রেন্ডলি ম্যাচেও এ দু’দলের খেলা থাকলে সেটি মহারণে পরিণত হয়। বিশ্বের ফুটবল-বোদ্ধারা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পরেন। বিংশ শতাবব্দীর গোড়াতে শুরু হওয়া এ দ্বৈরথ তার আকর্ষণ ধরে রেখেছে অধ্যাবধি।
শুধু আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের খেলা নয়, এ দ্বৈরথে ঘি ঢেলেছেন ফুটবলের কালোমানিক-খ্যাত পেলে ও ঈশ্বরের হাত-খ্যাত ম্যারোডোনাও। তাঁদের দু’জনের মধ্যে কে সেরা, সে বিতর্ক এখনো অমীমাংসিত। হয়তো কোনদিনই মীমাংসা হবেও না। নানাজন, নানা প্রতিষ্ঠান, নানা সময়ে একেকজনকে সেরা বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সে চেষ্টা কখনোই বিতর্কহীন থাকেনি। সেই বিতর্কে এখন উত্তাপ ছড়াচ্ছেন মেসি ও নেইমার। তবে পেলে-ম্যারোডোনার মত মেসি-নেইমারের তুলনা করার সময় এখনো আসেনি। কেননা, বিশ্ব এখনো মেসি-রোনাল্ডো নিয়েই ব্যস্ত। পেলে-ম্যারাডোনার মত মেসি ও রোনাল্ডোর মধ্যে কে সেরা- সে বিতর্ক এখনো শেষ হয়নি।
ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করালে দু’দলের শক্তি-সামর্থ্য প্রায় সমান সমান। তাই আগামীকাল রোববার ভোর ৬টায় শুরু হওয়া স্বপ্নের ম্যাচে কে হাসবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে সর্বশেষ ফিফা র্যাঙ্কিং অনুযায়ী ব্রাজিলের অবস্থান ১৭৪৩ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় এবং আর্জেন্টিনার র্যাঙ্কিং ১৬৪২ পয়েন্ট নিয়ে সপ্তম। এ থেকে ব্রাজিলই এগিয়ে আছে বলে মনে করা যায়। অন্যদিকে দু’দল সর্বশেষ পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল ২০১৯ সালের ১৫ নভেম্বরে রিয়াদে। মেসির একমাত্র গোলে আর্জেন্টিনা সে ম্যাচটি জিতেছিল। এ থেকে মনে হয়, আর্জেন্টিনাই এগিয়ে আছে।
বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সাফল্য যেমন ঈর্ষণীয়, তেমনি অন্যদিকে কোপায় আর্জেন্টিনাই সেরা দল।
সবশেষে বলতে চাই, যে-ই এগিয়ে থাকুক, যে-ই সেরা হোক, রিও ডি জেনেরিওর মহারণ যেন বাংলাদেশে কুরুক্ষেত্রের সৃষ্টি না করে সেটিই কাম্য। আমরা ঘরে বসে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলা দেখে বিমোহিত হতে চাই, আনন্দে আত্মহারা হতে চাই, নিজের দল গোল করলে হাততালিতে ঘর মুখরিত করতে চাই; কিন্তু কোন অবস্থাতেই সহিংস আচরণ করতে চাই না। বিজয়ী দলকে আগাম অভিনন্দন।
[লেখক : মোঃ শাহাদত হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ। মোবাইল- ০১৭১২২৭৭৫৫২]